যারা একসময় জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করেছিল, আজ তাদের উত্তরসূরিরা জাতিসংঘ-সহায়িত উন্নয়ন প্রকল্পে নির্বিঘ্নে নিয়োগ পাচ্ছে—এ যেন ইতিহাসের এক নির্মম ব্যঙ্গ। শহীদের রক্তে গড়া এই ভূমিতে এখন সেই চেতনাকে অপমান করে চলছে বিতর্কিত নিয়োগ প্রক্রিয়া।
সম্প্রতি বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ, ERRD-CHT ও UNDP-এর যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়িত “Biodiversity Ecosystem Restoration for Community Resilience (BERCR)” প্রকল্পের চূড়ান্ত নিয়োগ তালিকা প্রকাশিত হয়। তাতে স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, লামা উপজেলা শাখার সহসভাপতি মো. মাসুম (পিতা: আবুল কাশেম, মধুঝিরি, ওয়ার্ড-৭, লামা)। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়ভাবে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
অথচ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল: “প্রার্থীর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকলে তার পুলিশ ভেরিফিকেশন হবে এবং প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রার্থিতা বাতিল করা হবে।”
(সূত্র: নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, ২৭ এপ্রিল ২০২৫)
সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে—মাসুমের পরিচিত রাজনৈতিক ভূমিকা, ফেসবুক পোস্ট, মিছিলে অংশগ্রহণ—এসব উপেক্ষা করে কীভাবে তিনি পুলিশ ভেরিফিকেশন পাশ করলেন? প্রকল্প বাস্তবায়নে নীতিমালা লঙ্ঘন এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিয়ে এই প্রশ্ন এখন জেলা জুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে।
স্থানীয়রা বলছেন, এই নিয়োগ নির্লজ্জ পক্ষপাতের উদাহরণ। এক নাগরিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “সাধারণরা ছোট ভুলে বাদ পড়ে, আর মাসুম শুধু ছাত্রলীগ করেই চাকরি পায়! এটা প্রশাসনের চোখ রাঙানি নয়?”
আরেক তরুণ চাকরিপ্রার্থী বলেন, “আমরা যাদের সনদ, অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ছিল—তারা বাদ পড়েছি, অথচ মাসুম ছাত্রলীগ করায় নির্বাচিত! তাহলে মেধা আর যোগ্যতার দাম কোথায়?”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এক পরিবেশকর্মী লিখেছেন, “জাতিসংঘ-সহায়িত প্রকল্পেও যদি দলীয় প্রভাব চলে আসে, তাহলে মানুষ কোথায় যাবে?”
সংশ্লিষ্টদের মতে, এটি শুধু একজন মাসুমের নিয়োগ নয়—বরং পুরো প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে বান্দরবানে দলীয়করণের কারণে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীরা বঞ্চিত, আর ক্ষমতাসীন দলের অনুসারীরা পাচ্ছেন সুযোগ-সুবিধা।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এ ঘটনায় এখনো পর্যন্ত জেলা পরিষদ, BERCR প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কিংবা UNDP—কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি। এই নীরবতা জনমনে জন্ম দিচ্ছে আরও গভীর সন্দেহ—এমনকি আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার প্রকল্পেও যদি পক্ষপাতিত্ত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তা ভবিষ্যতের প্রকল্পগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে।
এমতাবস্থায় নাগরিক সমাজ, তরুণ প্রজন্ম, চাকরিপ্রার্থী ও পরিবেশ কর্মীরা চার দফা দাবি উত্থাপন করেছেন—
১. চূড়ান্ত তালিকার পেছনের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত
২. প্রকল্পের নিয়োগ আপাতত স্থগিত রেখে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা
৩. নিয়োগ বোর্ডের দায় নির্ধারণ ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
৪. ভবিষ্যতে সব নিয়োগে দলীয় প্রভাবমুক্ত স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
তাদের মতে, জাতিসংঘ-সহায়িত প্রকল্পে এমন বিতর্কিত নিয়োগ শুধু একজনকে চাকরি দেওয়া নয়, বরং তা গোটা প্রশাসনিক নীতির ওপর মানুষের আস্থাকে নষ্ট করে। আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা ও প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা রক্ষায় এখন জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন।
প্রশাসন ও সহযোগী সংস্থাগুলোর দায়িত্ব—এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা। নইলে এমন নিয়োগ ভবিষ্যতে আরও অনিয়ম ও পক্ষপাতের দ্বার খুলে দেবে।



















