নাম পরিবর্তন, কিন্তু বাস্তবে কোনো পরিবর্তন নেই দেশের তিনটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র নাম পরিবর্তনের এক যুগ পরও কাঙ্ক্ষিত কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনস্থ এসব প্রতিষ্ঠানে শিশুদের সংশোধনের জন্য যেসব সুবিধা থাকা প্রয়োজন, সেগুলোর অভাব প্রকট। চিকিৎসা, কাউন্সেলিং, দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ কিংবা পর্যাপ্ত শিক্ষক— কিছুই নেই।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু নাম পরিবর্তন করলেই কোনো প্রতিষ্ঠান উন্নত হয় না। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত জনবল ও কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন। অথচ, ২০১৩ সালে ‘উন্নয়ন কেন্দ্র’ হিসেবে কার্যক্রম শুরু করলেও এখন পর্যন্ত ‘কাউন্সেলর’ নিয়োগ করা হয়নি। ফলে শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
উন্নয়ন কেন্দ্রের বাস্তব চিত্র
দেশে বর্তমানে তিনটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে— গাজীপুর টঙ্গীর শিশু (বালক) উন্নয়ন কেন্দ্র গাজীপুর কোনাবাড়ীর শিশু (বালিকা) উন্নয়ন কেন্দ্র যশোর পুলেরহাটের শিশু (বালক) উন্নয়ন কেন্দ্র এসব কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য শিশুদের সংশোধন, তাদের অপরাধপ্রবণ মানসিকতা পরিবর্তন এবং দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এসব লক্ষ্যের একটিও ঠিকমতো পূরণ হচ্ছে না। জনবল সংকট এবং অব্যবস্থাপনা তিনটি কেন্দ্রে অনুমোদিত জনবল সংখ্যা ১৪৩ হলেও বর্তমানে মাত্র ৮৩ জন কর্মরত আছেন।
৬০টি পদ ফাঁকা থাকায় প্রশাসনিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। কেন্দ্রগুলোতে যথেষ্ট প্রশিক্ষক না থাকায় ৯টি ট্রেড কোর্স চালু করাও সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। টঙ্গী উন্নয়ন কেন্দ্রে ৩০০ শিশুর ধারণক্ষমতা থাকলেও সেখানে সাধারণত পাঁচ শতাধিক শিশু গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হয়। যশোর কেন্দ্রেও ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ শিশু রাখা হচ্ছে। ফলে শিশুদের জন্য যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
মৌলিক সুবিধার অভাব যে কোনো উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকা উচিত— পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স মানসিক উন্নয়নের জন্য কাউন্সেলিং ব্যবস্থা বিনোদন ও খেলাধুলার সুযোগ দক্ষতা উন্নয়নের জন্য ট্রেনিং কোর্স স্বাস্থ্যকর বাসস্থান ও খাদ্যব্যবস্থা কিন্তু বাস্তবে এসব সুবিধার অভাব প্রকট। উন্নয়ন কেন্দ্রের চিকিৎসা ব্যবস্থাও অস্থায়ী ভিত্তিতে চলছে। প্রতি সপ্তাহে স্বল্প সময়ের জন্য চিকিৎসক আনা হলেও এটি স্থায়ী সমাধান নয়। বিশেষজ্ঞদের মতামত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ফৌজিয়া করিম ফিরোজ বলেন,
“কাউন্সেলিং ব্যবস্থা ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানকে উন্নয়ন কেন্দ্র বলা যায় না। সরকারের নজরদারি ও জবাবদিহিতা না থাকায় সমস্যাগুলো দিন দিন বাড়ছে।” সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সমির মল্লিক স্বীকার করেছেন যে, জনবল সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। তার মতে, বর্তমানে প্রকল্পের আওতায় খণ্ডকালীন কিছু কাউন্সেলর কাজ করলেও প্রকল্প শেষ হলে বড় সংকট দেখা দেবে। করণীয় কাউন্সেলর নিয়োগ: শিশুদের মানসিক উন্নয়নের জন্য দ্রুত কাউন্সেলর নিয়োগ দিতে হবে। জনবল সংকট দূর করা: ফাঁকা পদগুলোতে দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা উন্নত করা: দক্ষতা উন্নয়নের জন্য সব ট্রেড কোর্স চালু করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা: প্রতিটি কেন্দ্রে স্থায়ী ডাক্তার ও নার্স নিয়োগ দিতে হবে। মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা: সরকারিভাবে উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
নাম পরিবর্তনের এক যুগ পরও কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে কেবল নাম পরিবর্তন নয়, বরং অবকাঠামোগত ও প্রশাসনিক সংস্কার করা জরুরি। সরকারের উচিত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে এসব শিশু সত্যিকার অর্থে একটি উন্নত ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।