বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য নাম নায়করাজ রাজ্জাক। মৃত্যুর ৮ বছর পরও তিনি ভক্তদের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন।
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম নায়করাজ রাজ্জাক। বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) এই কিংবদন্তি অভিনেতাকে হারানোর আট বছর পূর্ণ হলো। ২০১৭ সালের এই দিনে ৭৫ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তার চলে যাওয়া শুধু চলচ্চিত্রাঙ্গনেই নয়, পুরো জাতির সাংস্কৃতিক জীবনে এক গভীর শূন্যতা তৈরি করে।
রাজ্জাকের শিল্পযাত্রা শুরু হয়েছিল তার জন্মস্থান কলকাতায়। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি মঞ্চনাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে নিজের অভিনয় জীবনের প্রথম পদক্ষেপ নেন। ১৯৬৪ সালে জীবনের নতুন স্বপ্ন নিয়ে সপরিবারে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি। শুরুতে প্রচণ্ড কষ্ট ও সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। ধীরে ধীরে তিনি জায়গা করে নেন চলচ্চিত্রে। ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রের পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের সহযোগিতায় চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ পান এবং সেখান থেকেই শুরু হয় তার বড় পর্দার যাত্রা।
১৯৬৬ সালে ‘১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ ছবিতে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন রাজ্জাক। কিন্তু একই বছর জহির রায়হানের বিখ্যাত ছবি ‘বেহুলা’-য় লখিন্দরের চরিত্রে অভিনয় করে তিনি দর্শকের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নেন। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার অভিনীত প্রথম ছবি ছিল ‘মানুষের মন’। এই ছবিটি ব্যাপক সাফল্য পায় এবং শুরু হয় নায়করাজ যুগ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত ‘ওরা ১১জন’, ‘অবুঝ মন’, ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’সহ একাধিক সিনেমায় অভিনয় করে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক অদ্বিতীয় আইকন।
প্রায় পাঁচ দশকের অভিনয় জীবনে তিনি ৫০০টিরও বেশি বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে— বেহুলা, আগুন নিয়ে খেলা, এতটুকু আশা, নীল আকাশের নীচে, জীবন থেকে নেয়া, অবুঝ মন, রংবাজ, ওরা ১১জন, আলোর মিছিল, অশিক্ষিত, ছটির ঘণ্টা, বড় ভালো লোক ছিল, ও আমার দেশের মাটি ইত্যাদি। এই চলচ্চিত্রগুলো তাকে শুধু জনপ্রিয় নায়কই বানায়নি, বরং দেশের মানুষের হৃদয়ে চিরকালীন স্থান করে দিয়েছে।
নায়করাজ শুধু অভিনয়েই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি পরিচালনা করেছেন মোট ১৬টি চলচ্চিত্র। তার নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনস’-এর ব্যানার থেকে বেশ কয়েকটি সফল সিনেমা নির্মিত হয়।
তার অবদান অনন্য। জাতীয় চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। পাশাপাশি সংস্কৃতিতে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত করে।
নায়করাজ রাজ্জাকের চলে যাওয়া বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তবে আজও দর্শকরা তার সিনেমা দেখে, তার সংলাপ মনে করে, তার হাসি-কান্নায় ভেসে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়। মৃত্যুর আট বছর পরও তিনি অমর হয়ে আছেন কোটি ভক্তের হৃদয়ে।