বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সংস্কার ইস্যুতে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সংলাপ চালিয়ে এলেও মৌলিক অনেক বিষয়ে একমত হওয়া যায়নি। ফলে, ‘জুলাই সনদ’ নামে যে প্রতিশ্রুতিপত্র প্রণয়ন করার কথা, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য থাকলেও চলতি মাসের শেষ নাগাদ ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত করার চেষ্টা চলছে। তবে দেরি হলে ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র-জনতার সামনে ‘জুলাই ইশতেহার’ প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন (এনসিপি)।
কমিশন বলছে, ‘জুলাই সনদ’ হলো এমন একটি দলিল, যেখানে রাষ্ট্র সংস্কারে দলগুলোর মধ্যে যেসব প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো থাকবে। অন্যদিকে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ হবে সরকার ও দলগুলোর যৌথ উদ্যোগে প্রস্তুত একটি আলাদা দলিল।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন হয়। এর ভিত্তিতে সংবিধান, প্রশাসন, নির্বাচন, দুর্নীতি দমনসহ ১৬৬টি সুপারিশ তৈরি হয়। কমিশন জানায়, এর মধ্যে প্রায় ৮০টির ওপর রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে এবং আরও প্রায় ২০টি বিষয়ে আলোচনা চলছে।
এখন পর্যন্ত যে ৫টি বিষয়ে সকল দল একমত, সেগুলো হলো—
-
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার,
-
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব পরিবর্তন,
-
নির্বাচনি সীমানা পুনর্নির্ধারণ,
-
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সংক্রান্ত বিধান সংশোধন,
-
হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ।
তবে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস, দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদে আলাদা ব্যক্তি নিয়োগ, ও ‘জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ’ গঠনের মতো ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে এখনো মতভেদ রয়েছে।
বিএনপি প্রশ্ন তুলেছে—সব বিষয়েই যদি ঐকমত্য কমিশনের মত মানতে হয়, তবে আলোচনার দরকার কী ছিল? তবে অধ্যাপক রীয়াজ জানিয়েছেন, মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও আলোচনার দরজা খোলা আছে এবং কমিশন আশাবাদী যে ঐকমত্যে পৌঁছানো যাবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রশ্নেও দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। কারও মতে সংসদের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন সম্ভব, কেউ বলছে গণপরিষদ নির্বাচন জরুরি, আবার কেউ বলছে গণভোটই একমাত্র উপায়।
ঐকমত্য কমিশনের বক্তব্য, তারা শুধু সংস্কারের বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করছে (What), কিন্তু বাস্তবায়নের রূপরেখা (How) ঠিক করবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো মিলেই।
কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “এখন ঐকমত্য দরকার—না হলে আবারও স্বৈরতন্ত্রের উত্থান ঠেকানো যাবে না।”
বিশ্লেষকেরা বলছেন, জুলাই সনদ শুধু সংস্কার পরিকল্পনা নয়, বরং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেও বিবেচিত হবে।