close

ভিডিও দেখুন, পয়েন্ট জিতুন!

জিলহজ: ইবাদতের মহোৎসব ও আত্মিক পরিশুদ্ধির অনন্য সময়- এম. আব্দুল্লাহ..

Rokibul Islam Rocky avatar   
Rokibul Islam Rocky
জিলহজ: ইবাদতের মহোৎসব ও আত্মিক পরিশুদ্ধির অনন্য সময়- এম. আব্দুল্লাহ

 

এম.আব্দুল্লাহ ::

জিলহজ মাস আমাদেরকে ত্যাগের মহিমা শেখায়। ইব্রাহিম (আ.) যেমন তাঁর প্রিয় পুত্রকে আল্লাহর নির্দেশে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন, তেমনি মুসলিমদেরও আল্লাহর পথে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এই ত্যাগ শুধু সম্পদের নয়, বরং নিজের আকাঙ্ক্ষা, কুপ্রবৃত্তি এবং সবরকম জাগতিক মোহের ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই এর মূল লক্ষ্য। পবিত্র জিলহজ মাস রমজানের মতো এই মাসটিও ইবাদত ও নেক আমলের এক সোনালি সুযোগ নিয়ে আসে। এটি কেবল একটি মাসের আগমন নয়, বরং এটি ইবাদতের এক মহোৎসব, ত্যাগের মহিমা এবং আত্মিক পরিশুদ্ধির এক অনন্য সুযোগ নিয়ে আসে। রমজান মাস যেমন সিয়াম ও কিয়ামুল লাইলের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির বার্তা নিয়ে আসে, তেমনি জিলহজ আসে হজ, কোরবানি এবং ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক অভূতপূর্ব সুযোগ নিয়ে। রমজানের শেষ দশ রাত যেমন ফজিলতপূর্ণ, তেমনি জিলহজের প্রথম দশ দিন বছরের সেরা দিনগুলোর অন্তর্ভুক্ত। হাদিসে এসেছে, "আল্লাহর কাছে জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের ইবাদতের চেয়ে অধিক প্রিয় আর কোনো দিনের ইবাদত নেই।" (বুখারি: ৯৬৯) 

জিলহজের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব-
ইবরাহিম (আ.)-এর পরীক্ষা: জিলহজ মাস হজ ও কোরবানির মাধ্যমে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সেই অতুলনীয় আত্মত্যাগের স্মৃতি বহন করে। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে স্বপ্নযোগে প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইবরাহিম (আ.) এবং ইসমাইল (আ.) উভয়েই আল্লাহর এই নির্দেশ পালনে একনিষ্ঠভাবে প্রস্তুত ছিলেন। এই ঘটনা মানবজাতির জন্য আনুগত্য, ত্যাগ এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কোরবানি শুধু পশুর রক্তপাত নয়, এটি আমাদের ভেতরের পশুত্ব, লোভ, অহংকার এবং ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাকে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করার প্রতীক।

হজের ফযিলত: ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ এই মাসেই আদায় করা হয়। হজ এমন এক ইবাদত যা মুসলিম উম্মাহকে ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে এক বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে একত্রিত করে। লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত আরাফাতের ময়দান, মিনা ও মুজদালিফার সেই অলৌকিক পরিবেশ বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ব ও সমতার এক জীবন্ত প্রমাণ। হজ শুধুমাত্র শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত নয়, এটি একজন হাজীর আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে, তাঁকে গুনাহমুক্ত করে মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ করে তোলে।

কুরআনের ইঙ্গিত: সূরা আল-ফাজরের প্রথম আয়াতে "দশটি রাতের শপথ" দ্বারা মুফাসসিরদের অনেকেই জিলহজের প্রথম দশ রাতকে বুঝিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো কিছুর শপথ করেন, তখন সেটির গুরুত্ব এবং মর্যাদা অপরিসীম হয়। এটি এই দশ দিনের আধ্যাত্মিক তাৎপর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "আল্লাহর কাছে জিলহজের দশ দিনের নেক আমল অপেক্ষা অধিক প্রিয় আর কোনো দিনের আমল নেই।" (বুখারি: ৯৬৯) এই হাদিস এই দিনগুলোর অতুলনীয় গুরুত্ব প্রমাণ করে। এই দিনগুলোতে প্রতিটি ভালো কাজের প্রতিদান বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

আমল ও তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য:
১. বেশি বেশি তাকবির বলা: জিলহজের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত এবং বিশেষ করে ৯ই জিলহজ ফজরের পর থেকে ১৩ই জিলহজ আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ সালাতের পর উচ্চস্বরে তাকবির বলা। বাক্যটি হলো: "আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।" এই তাকবির শুধু মুখে উচ্চারণ করা নয়, এটি আমাদের অন্তরে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, তাঁর বড়ত্ব এবং সকল প্রশংসার একমাত্র তিনিই মালিক – এই বিশ্বাসকে বদ্ধমূল করে। এটি আমাদের আত্মাকে জাগিয়ে তোলে, জাগতিক ব্যস্ততা থেকে মুক্তি দিয়ে আল্লাহর স্মরণে নিবিষ্ট করে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বাজারে গিয়ে উচ্চস্বরে তাকবির দিতেন, এর কারণ ছিল যেন সকল মানুষ আল্লাহর বড়ত্ব স্মরণ করতে পারে এবং ইবাদতের প্রতি উৎসাহিত হয়।

২. রোজা রাখা: জিলহজের প্রথম নয় দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব। বিশেষ করে ৯ই জিলহজ, অর্থাৎ আরাফার দিনের রোজা রাখা। আরাফার দিনের রোজার ফযিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "আরাফার দিনের রোজা আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে আশা করি যে, তিনি এর দ্বারা পেছনের এক বছর ও সামনের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।" (মুসলিম) এটি এক বিশাল সুযোগ যা কেবল হজে থাকা ব্যক্তিরা নন, বরং বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মুসলিমরা লাভ করতে পারে। সিয়াম আমাদের আত্মাকে পরিশীলিত করে এবং আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে সাহায্য করে।

৩. নফল সালাত আদায়: তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশত, আওয়াবিনের মতো নফল সালাত এই দিনগুলোতে বেশি বেশি আদায় করা। ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি নফল ইবাদত বান্দাকে আল্লাহর আরও নিকটবর্তী করে। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, "আমার বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার নিকটবর্তী হতে থাকে, একসময় আমি তাকে ভালোবাসি।" (বুখারী: ৬৫০২) এই দিনগুলোতে নফল সালাতের সওয়াব অন্যান্য দিনের চেয়ে বহুগুণে বেশি।

৪. সাদাকা ও দান: অভাবী ও দরিদ্রদের মাঝে সাদাকা, খাদ্য বিতরণ এবং সামর্থ্য অনুযায়ী দান-খয়রাত করা। ইসলামে দানের গুরুত্ব অপরিসীম। জিলহজের বরকতময় দিনগুলোতে দান করা অভাবীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের পাশাপাশি নিজেদের সম্পদকে পরিশুদ্ধ করার এক উপায়। এটি তাকওয়ার পরিচয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ।

৫. কুরআন তিলাওয়াত ও জিকির-আজকার: প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত করা, আস্তাগফিরুল্লাহ, সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ ইত্যাদি জিকির বেশি বেশি করা। আল্লাহর স্মরণ আমাদের আত্মাকে শান্তি দেয় এবং হৃদয়কে আলোকিত করে। এই দিনগুলোতে আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন থাকা আমাদের ঈমানকে সতেজ করে এবং আমাদের লক্ষ্য যে আখিরাত, তা মনে করিয়ে দেয়।

৬. দু'আ: বিশেষভাবে আরাফার দিনে এবং জিলহজের অন্যান্য দিনগুলোতে বেশি বেশি দু'আ করা। দু'আ হলো ইবাদতের মূল। এই দিনগুলোতে আল্লাহ তায়ালা বান্দার দু'আ অধিক কবুল করেন। নিজেদের জন্য, পরিবারের জন্য, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য এবং মানবজাতির কল্যাণের জন্য দু'আ করা উচিত।

জিলহজ আমাদের জন্য এক জাগরণ: রমজানের আত্মশুদ্ধি এবং জিলহজের ত্যাগের মহিমা—এ দুটিই মুসলিম জীবনকে পূর্ণতা দেয়। যারা হজের পবিত্র ভূমিতে পদার্পণ করতে পারেননি, তাদের জন্য জিলহজের এই প্রথম দশ দিন নিছক সাধারণ কিছু দিন নয়। এটি আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ সুযোগ, যেন আমরা ইবাদত ও নেক আমলের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ করতে পারি।

আসুন, আমরা এই পবিত্র মাসটিকে কেবল ঈদুল আজহার পশু কোরবানিতে সীমাবদ্ধ না রেখে, এর প্রতিটি মুহূর্তকে আল্লাহর ইবাদত এবং আত্মিক উন্নয়নে কাজে লাগাই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততার মাঝেও যেন আল্লাহর স্মরণ, জিকির ও তাকবির ধ্বনি আমাদের অন্তরে অনুরণিত হয়। সর্বক্ষণ বলুন, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ। 

এই ধ্বনিই হোক আমাদের আত্মিক সান্ত্বনা, আল্লাহর সাথে সংযোগের মাধ্যম এবং ত্যাগের পথে অবিচল থাকার প্রেরণা।

Nenhum comentário encontrado