গবেষণায় ব্যাপক নকলের প্রমাণ সত্ত্বেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষিকা ড. মর্জিনা খাতুনকে পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও একাডেমিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান, নৈতিকতা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিয়ে।
ড. মর্জিনা খাতুনের অন্তত চারটি গবেষণা প্রবন্ধে উচ্চমাত্রার প্ল্যাজিয়ারিজমের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সফটওয়্যার ‘Ithenticate’ ব্যবহার করে যাচাই করলে দেখা যায়, তাঁর প্রবন্ধগুলোর অনুরূপতার হার যথাক্রমে ৭৭ শতাংশ, ৪৮ শতাংশ, ৩১.২০ শতাংশ এবং ২৮ শতাংশ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের জার্নাল অন্বেষণ-এর বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর মধ্যে “Metaphysical Status of Self in Sankara and Hegel: A Comparison” প্রবন্ধে ৭৭ শতাংশ, “Gandhi-Tagore Debates on Truth and Untruth: A Philosophical Quest” প্রবন্ধে ৪৮ শতাংশ এবং “Is Rabindranath Tagore a Mystic?: A Philosophical Analysis” প্রবন্ধে ৩১.২০ শতাংশ অনুরূপতা ধরা পড়ে।
এছাড়া, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের Journal of Teacher Education-এ প্রকাশিত “Enlightenment Rationality: A Critical Analysis of Jürgen Habermas's Critique of Karl Marx” প্রবন্ধে ২৮ শতাংশ প্ল্যাজিয়ারিজম চিহ্নিত হয়। এই প্রবন্ধে একাধিক বাক্য ও অনুচ্ছেদ বিভিন্ন লেখকের কাজ থেকে সরাসরি নেওয়া হয়েছে কোনো স্বীকৃতি বা সূত্র ছাড়া। উদাহরণস্বরূপ, অশোক কুমার উপাধ্যায়ের ২০০২ সালে The Indian Journal of Political Science-এ প্রকাশিত “Multiculturalism and Crisis of Democratic Governance” শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে ২৯ শব্দের একটি বাক্য ও ১০৪ শব্দের একটি সম্পূর্ণ অনুচ্ছেদ হুবহু কপি করা হয়েছে, যা উক্ত প্রবন্ধের উপসংহারে ব্যবহৃত হয়েছে। উপরন্তু, Bhikhu Parekh-এর “Rethinking Multiculturalism” গ্রন্থ থেকে টানা তিনটি প্যারা এবং Habermas-এর “The Structural Transformation of the Public Sphere” ও Kymlicka-এর লেখাগুলো থেকেও উৎসহীনভাবে তথ্য গ্রহণ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, উপসংহার লেখার মতো মৌলিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ অংশে সরাসরি কপি-পেস্ট করার ঘটনা ড. মর্জিনা খাতুনের গবেষণা সক্ষমতা ও সততা দুটোই প্রশ্নবিদ্ধ করে। এমন একজন গবেষক যিনি নিজে উপসংহার লেখারও যোগ্যতা দেখাতে পারেন না, তাঁর গবেষণাকর্ম একাডেমিকভাবে মূল্যহীন বলে মনে করছেন অনেকেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গবেষণা নীতিমালায় ৩০ শতাংশের বেশি অনুরূপতাকে গবেষণা অনিয়ম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এই সীমা ২০ শতাংশে নির্ধারণ করেছে। সেই হিসাবে ড. মর্জিনা খাতুনের অন্তত তিনটি প্রবন্ধ গবেষণা নীতিমালা ভঙ্গ করেছে। তবুও তাঁর বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করা হয়েছে—যা ঘিরে ক্ষোভ আরও বাড়ছে জবি ক্যাম্পাসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, “৩০ শতাংশের বেশি অনুরূপতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রশাসন চাইলে তদন্ত কমিটি গঠন করে পদোন্নতি স্থগিত বা বাতিল করতে পারে। কিন্তু এখানে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যা গভীর উদ্বেগের বিষয়।”
এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, ড. মর্জিনা খাতুন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করলেও তাঁর থিসিস কপি এখনও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি বা বিভাগীয় সেমিনারে জমা দেননি। অথচ এটি নীতিমালাভিত্তিক বাধ্যতামূলক। অনেকের মতে, থিসিসেও অনুরূপ জালিয়াতি থাকতে পারে বলেই তা গোপন রাখা হচ্ছে।
জানা গেছে, এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে প্ল্যাজিয়ারিজমের অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই তদন্ত প্রতিবেদন গোপন রেখে এবারকার পদোন্নতির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া অভিযোগকারীকেই তদন্তে ডাকা হয়নি বলে জানা গেছে। এতে একাডেমিক পরিবেশের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জায়গা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।



















