জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস চার দিনের সফরে ঢাকায় পৌঁছেছেন, যা বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক পর্ব। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে এই সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যেখানে রোহিঙ্গা সংকট ও মানবাধিকার ইস্যু বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।
গুতেরেসের এই সফর প্রায় সাত বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার, তার আগের বাংলাদেশ সফর ছিল ২০১৮ সালের জুলাই মাসে। তবে এবারের সফর ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা, রোহিঙ্গা সমস্যা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনার কেন্দ্রে। জাতিসংঘ মহাসচিবের উপস্থিতি এসব ইস্যুতে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সফরের মূল এজেন্ডা হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। জাতিসংঘ মহাসচিব কক্সবাজার সফরে গিয়ে সরাসরি রোহিঙ্গাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবেন এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা তাকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ করবে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতারের পরিকল্পনা করেছেন গুতেরেস, যা সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতির প্রকাশ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদী অবস্থান বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। মিয়ানমার সরকার এখনো তাদের ফেরত নেওয়ার কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। জাতিসংঘ এই সমস্যার সমাধানে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে, সেটাই বড় প্রশ্ন।
সফরে মানবাধিকার পরিস্থিতিও আলোচনার শীর্ষে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে জাতিসংঘের অবস্থান কী হবে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে ড. ইউনূস কীভাবে এই সফর ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবেন, সেটাও দেখার বিষয়। তিনি ইতোমধ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পরিকল্পনা করেছেন, যেখানে বাংলাদেশ সরকার পরিচালনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হবে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমীকরণেও প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে এই সফরকে ব্যবহার করবে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধী দলগুলো যদি জাতিসংঘের মাধ্যমে সরকারবিরোধী অবস্থান শক্তিশালী করতে চায়, তাহলে সরকারকেও আন্তর্জাতিক মহলে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হবে।
অন্যদিকে, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পরাশক্তিগুলোও এই সফরের দিকে নজর রাখছে। কারণ রোহিঙ্গা সংকট, মানবাধিকার ইস্যু এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে তাদের স্বার্থ জড়িত রয়েছে।
গুতেরেসের সফর শেষ হলে কতটুকু বাস্তব পরিবর্তন আসবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। জাতিসংঘ বরাবরই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছে, তবে কূটনৈতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
সফরের মাধ্যমে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে বাংলাদেশ সরকারের জন্য এই সফর এক ধরনের সুযোগ, যেখানে তারা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে এবং জাতিসংঘের সহায়তা নিশ্চিত করতে পারে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বাস্তবিক পরিবর্তন আনতে হলে শুধু প্রতীকী পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, মানবাধিকার রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে জাতিসংঘকে আরও সক্রিয় হতে হবে। গুতেরেসের এই সফর কেবল কূটনৈতিক সৌজন্য নাকি বাস্তব পরিবর্তনের সূচনা—তা সময়ই বলে দেবে।