ড্রাগন ফল, যা পিটায়া বা স্ট্রবেরি নাশপাতি নামেও পরিচিত, তার আকর্ষণীয় এবং প্রাণবন্ত চেহারার কারণে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করেছে। এটি কেবল একটি ফল নয়, বরং এর পুষ্টিগুণ, স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য একে আরও বিশেষ করে তুলেছে। মূলত মধ্য আমেরিকা এবং মেক্সিকোর স্থানীয় হলেও, বর্তমানে এটি বাংলাদেশসহ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এবং ক্যারিবিয়ানের মতো উষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে সফলভাবে চাষ করা হচ্ছে।
ড্রাগন ফলের নামকরণ হয়েছে এর বাহ্যিক গঠনের কারণে। ফলটির বাইরের ত্বক উজ্জ্বল গোলাপী বা হলুদ রঙের হয় এবং তাতে থাকে সবুজ রঙের আঁশ বা ফ্ল্যাপ, যা দেখতে কল্পিত ড্রাগনের আঁশের মতো। এই অনন্য রূপই ফলটির নামের পেছনে মূল কারণ। এটি ক্যাকটাস পরিবারের একটি সদস্য, যা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পরিবেশে সহজেই বৃদ্ধি পায়। এই গাছের পাতা বা কাঁটা নেই, বরং এর ডাল থেকেই ফল ধরে।
ড্রাগন ফলের প্রধানত তিন ধরনের বাণিজ্যিক প্রজাতি রয়েছে:
-
Hylocereus undatus (সাদা শাঁসের ড্রাগন ফল): এটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। এর ত্বক গাঢ় গোলাপী এবং ভেতরের শাঁস সাদা রঙের। স্বাদে এটি হালকা মিষ্টি এবং সতেজ।
-
Hylocereus polyrhizus (লাল শাঁসের ড্রাগন ফল): এর ত্বক এবং শাঁস উভয়ই গোলাপী বা লাল রঙের হয়। এই ধরনের ফল সাদা শাঁসের ফলের তুলনায় কিছুটা মিষ্টি এবং স্বাদে আরও বেশি আকর্ষণীয়।
-
Hylocereus megalanthus (হলুদ ড্রাগন ফল): এই প্রজাতিটি তুলনামূলকভাবে বিরল। এর ত্বক হলুদ রঙের এবং ভেতরের শাঁস সাদা। স্বাদে এটি অন্য দুটি প্রজাতির চেয়ে বেশি মিষ্টি।
প্রতিটি প্রজাতির শাঁসের ভেতরেই কিউই ফলের মতো ছোট ছোট নরম কালো বীজ থাকে, যা সম্পূর্ণ ভোজ্য। এই বীজগুলো ফলটির পুষ্টিগুণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ড্রাগন ফল কেবল দেখতেই সুন্দর নয়, এটি পুষ্টিগুণেও ভরপুর। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এটিকে সুপারফুড হিসেবে গণ্য করেন।
-
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: ড্রাগন ফলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন ফ্ল্যাভোনয়েড, বিটালায়িনস এবং হাইড্রক্সিচিনামিক অ্যাসিড থাকে। এই উপাদানগুলো কোষের ক্ষতি রোধ করে এবং শরীরের ফ্রি র্যাডিক্যালস দূর করতে সাহায্য করে।
-
ভিটামিন ও খনিজ: এটি ভিটামিন সি-এর একটি চমৎকার উৎস, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত করে। এছাড়া, এতে রয়েছে আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, যা হাড়ের স্বাস্থ্য এবং রক্ত সঞ্চালনের জন্য অপরিহার্য।
-
উচ্চ ফাইবার: ড্রাগন ফলে প্রচুর ফাইবার থাকায় এটি হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সহায়তা করে। ফাইবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর।
-
হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস: ফলের বীজগুলোতে ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
-
ওজন নিয়ন্ত্রণ: এর কম ক্যালোরি এবং উচ্চ ফাইবার উপাদান এটিকে ওজন কমানোর জন্য একটি আদর্শ ফল হিসাবে পরিচিতি দিয়েছে।
ড্রাগন ফল চাষের জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু প্রয়োজন। এটি ক্যাকটাস হওয়ায় কম পানি এবং কম সারেও ভালো ফলন দেয়। বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু ড্রাগন ফল চাষের জন্য খুবই উপযুক্ত।近年, বাংলাদেশে এর বাণিজ্যিক চাষ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং অনেক কৃষক লাভবান হচ্ছেন। ফলন কম সময়ে পাওয়া যায় এবং বাজারে এর চাহিদা ও দাম বেশি হওয়ায় এটি কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক ফসল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ড্রাগন ফল সরাসরি কেটে খাওয়া যায়। এটি কাটার জন্য একটি ধারালো ছুরি ব্যবহার করে ফলটিকে অর্ধেক করে কেটে চামচ দিয়ে এর শাঁস তুলে খাওয়া যায়। এর মিষ্টি ও হালকা স্বাদ এটিকে স্মুদি, সালাদ, জুস এবং ডেজার্টের একটি জনপ্রিয় উপাদান করে তুলেছে। এর উজ্জ্বল রঙ যেকোনো খাবারকে আকর্ষণীয় করে তোলে।
ড্রাগন ফল কেবল একটি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর ফলই নয়, এটি বৈচিত্র্য, সৌন্দর্য এবং স্বাস্থ্যের প্রতীক। এটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফলের জগতে একটি নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে, এবং এর জনপ্রিয়তা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।