ফেনী জেলার ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার হাজার হাজার মানুষের জন্য প্রতিবছরের বর্ষা যেন আতঙ্ক হয়ে আসে। নদী ভাঙন আর ভয়াবহ বন্যা এখানকার নিয়মিত দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। অথচ এই দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও আজও টেকসই কোনো বাঁধ নির্মিত হয়নি। ফলে এলাকাবাসী পানিবন্দি হয়ে জীবন-জীবিকার দারুণ সংকটে পড়ছেন।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ফুলগাজী-পরশুরামে বাঁধ মেরামত ও নির্মাণের জন্য প্রায় ৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এই বরাদ্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
২০১৮ সালে ২.৪৪ কোটি টাকা
২০১৯ সালে ১.৭৯ কোটি
২০২০ সালে ১.৫ কোটি
২০২১ সালে ২.১৩ কোটি
২০২২ সালে ৭১ লাখ
২০২৩ সালে ১.৩৩ কোটি
২০২৪ সালে ১.২৫ কোটি ও ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী জরুরি বরাদ্দে আরও ২০ কোটি টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, এই টাকার বড় একটি অংশ শুধুমাত্র 'সাময়িক মেরামত' বা ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ প্রকল্পে খরচ করা হয়। বাস্তবে বাঁধ নির্মাণের কাজ খুবই দুর্বল এবং অস্থায়ী। ফলে প্রতি বছর বর্ষায় মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বাড়লেই বাঁধ ভেঙে গ্রাম প্লাবিত হয়।
২০২৪ সালের বন্যা ছিল সর্বনাশা।
আগস্ট মাসে টানা বৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে মুহুরী নদীর ৩৫টি পয়েন্ট দিয়ে পানি ঢুকে পড়ে। এতে ফুলগাজী ও পরশুরামের ৪৩টি গ্রামের ২৮ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৯১ কোটি টাকা। গবাদিপশু, মাছের ঘের, ফসল, ঘরবাড়ি, দোকান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—সব কিছুই তলিয়ে যায় পানির নিচে।
এদিকে ২০২৫ সালের বর্ষা মৌসুম শুরু হতেই, ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় দুটি স্থানে নদী নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে — উত্তর বরইয়া (ফুলগাজী সদর ইউনিয়ন) এবং গোসাইপুর (সিলোনিয়া এলাকার অংশ) । এতে উত্তর বরইয়া, দক্ষিণ বরইয়া, বণিকপাড়া, বসন্তপুর, জগতপুরসহ অন্তত ছয়টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে ।
একই সময়ে, পরশুরামে মনিপুর ইউনিয়নের মির্জানগর এলাকায় বাঁধ উপচে প্লাবনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ।
স্থানীয়রা জানান, “**প্রতিবছর মেরামতের নামে অস্থায়ী কাজ হয়, বাঁধ আবার ভেঙে যায়। জনগণ কষ্টে পড়ে, সরকার টাকা দেয়, কিন্তু টেকসই বাঁধ তৈরি হয় না—টাকা কোথায় যায়?”**
বন্যার কারণে স্থানীয়দের ঘরে রান্না করা বন্ধ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিচ্ছিন্ন, কৃষি জমির ব্যাপক ক্ষতি, রাস্তা ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক ও খামারিরা। অনেক পরিবার এখনো পূর্বের ক্ষতির ক্ষত সারাতে পারেননি।
এ বিষয়ে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি ও সাবেক এক জনপ্রতিনিধি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,প্রতিবছর বরাদ্দ এলেও প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নেই। "কিছু কাজ হয়, কিন্তু তা টেকে না। ঠিকাদাররা ঠিকমতো কাজ করে না, পাউবোও তদারকিতে ঢিলেঢালা।"
অন্যদিকে, সাধারণ জনগণের দাবি, টেকসই বাঁধ নির্মাণ ছাড়া ফুলগাজী-পরশুরামের মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। তারা সরকারের কাছে অবিলম্বে সুষ্ঠু তদন্ত এবং টেকসই বাঁধ নির্মাণের জোর দাবি জানিয়েছেন।
বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার না হওয়ায় এবং বারবার ‘মেরামত’ নামক অনিয়মের ফাঁদে পড়ে ফুলগাজী ও পরশুরামের মানুষ বছরের পর বছর ধরে ভয়াবহ বন্যা ও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এখনই সময়—দুর্নীতির জাল ছিন্ন করে টেকসই বাঁধ নির্মাণ নিশ্চিত করার।