দেশের সেরা বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে খ্যাত ইসলামী ব্যাংক এবার ৩২ বছরে প্রথমবার লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এস আলম গ্রুপের ব্যাপক ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি ৬৯ হাজার ৭৭০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
দেশের ব্যাংকিং খাতে এক সময় স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এখন তীব্র সংকটে। ১৯৮৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকে ব্যাংকটি শীর্ষ মুনাফাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে ব্যাংকটির ইতিহাসে এক নজিরবিহীন সংকট তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ ৩২ বছর পর এবার ব্যাংকটি কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারেনি।
এই ব্যর্থতার মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের ব্যাপক ঋণ কেলেঙ্কারি। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এস আলম গ্রুপ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকিং নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। ফলে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৯ হাজার ৭৭০ কোটি টাকায়, যা লভ্যাংশ ঘোষণার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।
মাত্র এক বছর আগেও ইসলামী ব্যাংক দেশের সর্বোচ্চ মুনাফাকারী বেসরকারি ব্যাংক ছিল। ২০২৩ সালে এর নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছিল ৬৩৫ কোটি টাকা। কিন্তু খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে ২০২৪ সালে ব্যাংকটি লোকসানে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্তে প্রভিশন সংরক্ষণে ছাড় পাওয়ায় কৃত্রিমভাবে ১০৮ কোটি টাকার মুনাফা দেখানো হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিধিনিষেধের কারণে এবার লভ্যাংশ ঘোষণা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সিনিয়র নির্বাহী জানান, ব্যালেন্স শিটে লোকসান দেখানো হলে বিদেশি ঋণদাতাদের আস্থা নষ্ট হতো। এজন্য কাগজে-কলমে মুনাফা দেখানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তবুও ব্যাংকটির বিপুল প্রভিশন ঘাটতি স্বীকার করেই নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করতে বলা হয়েছে। ফলে ইসলামী ব্যাংক বাধ্য হয়েই লভ্যাংশ ঘোষণা থেকে বিরত থাকে।
এ অবস্থায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ব্যাংকটি ‘এ’ ক্যাটাগরি থেকে অবনমিত হয়ে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নামছে। এর ফলে শেয়ারহোল্ডারদের আস্থায় বড় ধাক্কা লাগবে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তবে ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওমর ফারুক খান দাবি করেছেন, সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। কারণ ৮২ শতাংশ শেয়ার এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ছিল, যা ইতিমধ্যেই জব্দ হয়েছে।
তিনি আরও জানান, গণঅভ্যুত্থানের পর ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন হওয়ায় গত এক বছরে ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি উন্নত হয়েছে। ২০২৩ সালে যেখানে মূল অ্যাকাউন্ট ও সিআরআরে ঘাটতি ছিল, এখন সেখানে উদ্বৃত্ত রয়েছে। গ্রাহকদের আস্থা ফেরায় গত ছয় মাসে ব্যাংকটিতে নতুন করে ১৫ হাজার কোটি টাকার আমানত জমা হয়েছে।
তবে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, প্রকৃত চিত্র এখনো গুরুতর। এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম দেশত্যাগ করায় অধিকাংশ ঋণ খেলাপি অবস্থায় আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে জব্দ করা শেয়ার বিক্রির জন্য দেশি-বিদেশি কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। একইসঙ্গে ইসলামী ব্যাংক অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করে এস আলমের সম্পদ নিলামে তুলেছে।
উল্লেখ্য, এস আলম গ্রুপ ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক অধিগ্রহণ করে। তৎকালীন সরকার ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে গ্রুপটি কোনো বাধা ছাড়াই ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরবর্তীতে কিছু অখ্যাত কোম্পানি ব্যাংকের বড় অঙ্কের শেয়ার কিনে নেয়, কিন্তু তাদের অর্থের উৎস নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেউই প্রশ্ন তোলে নি। সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে এবং ব্যাংকটিকে এস আলমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে।
অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অনুযায়ী, এস আলম গ্রুপের হাতে ব্যাংকটির সবচেয়ে বড় ক্ষতিই হয়েছে। নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করায় একসময়ের শীর্ষ মুনাফাকারী ব্যাংক এখন প্রভিশন ঘাটতি আর খেলাপি ঋণের পাহাড়ে জর্জরিত। ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কেবল ইসলামী ব্যাংকের সংকট নয়, বরং গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থায় বড় আঘাত।