দুই উপদেষ্টার এপিএস-পিও হাতিয়েছেন শতকোটি টাকা, অন্তর্বর্তী সরকারের ছায়াতলে গড়ে ওঠা কেলেঙ্কারির চিত্র..

Abdullah Al Mamun avatar   
Abdullah Al Mamun
প্রতিবেদনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের ব্যক্তিগত সহকারীদের বিরুদ্ধে ওঠা তদবির বাণিজ্য, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সূত্র: যুগান্তর।..

বাংলাদেশে যখনই কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে, তখন এক ধরনের নতুন আশার সঞ্চার হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সময়ও মানুষ ভেবেছিল, এবার হয়তো দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত, নিরপেক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবতা যেন ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের ঘনিষ্ঠ সহকারীদের বিরুদ্ধে যেসব তদবির ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তা শুধু হতাশারই নয়, বরং ভয়ানক অশনিসংকেত।

এই অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনে আমরা তুলে ধরব কীভাবে একদল তরুণ উপদেষ্টা ও তাদের সহযোগীরা ক্ষমতার ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, আর কীভাবে "নতুন মুখ" বলে পরিচিতরা পুরনো দুর্নীতির ফাঁদে পা দিয়ে জনগণের আস্থাকে ভেঙে দিয়েছেন।

মোয়াজ্জেম হোসেন: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে তদবিরের কারবারি

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার একান্ত সহকারী সচিব হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই আলোচনায় আসেন মোয়াজ্জেম হোসেন। অতীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হিসেবে পরিচিত এই তরুণ হঠাৎই রূপ নেন এক শক্তিশালী এপিএসে, যিনি সরকারি অফিস-আদালতে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত অবস্থান করতেন এবং তদবির করতেন কোটি কোটি টাকার কাজের জন্য।

অভিযোগ রয়েছে, এলজিইডি (স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর)-র প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে উপজেলা প্রকৌশলী পর্যন্ত প্রায় সব পর্যায়ে বদলি ও নিয়োগে মোয়াজ্জেমের প্রত্যক্ষ তদবির ছিল। শুধু তাই নয়, তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত অধিদপ্তর—প্রায় সবখানে ঘুরে বেড়িয়ে ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেওয়ার দালালি করতেন।

বিশেষ করে ঠিকাদারদের বিল পাস করানো, অস্ত্র-গোলাবারুদ কেনার অনুমোদন পেতে সহায়তা, প্রকৌশলীদের পদায়ন—সবকিছুতেই মোয়াজ্জেম ছিলেন সক্রিয়। একাধিক সূত্র জানায়, তিনি ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন এবং এসব টাকা বিদেশে পাচার করেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ছাত্র প্রতিনিধি পরিচয়ে সিন্ডিকেট

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত তুহিন ফারাবি এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ডা. মাহমুদুল হাসান—এই দুইজনের নাম উঠে এসেছে সবচেয়ে বেশি আলোচিত সিন্ডিকেট হিসেবে। অভিযোগ অনুসারে, তারা চিকিৎসক, মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল, পরিচালক, উপপরিচালক, সিভিল সার্জন পদে বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন। প্রতিটি বদলিতে তারা আদায় করতেন ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।

সিনিয়র স্টাফ নার্স ও মিডওয়াইফ পদেও বদলি বাণিজ্য করতেন তারা, প্রতি বদলিতে নিতেন দুই লাখ টাকা। এমনকি হজ টিমে ডাক্তার বা নার্স হিসেবে যাওয়ার সুযোগ করে দিতেও তারা অর্থ নিতেন।

সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর ফারাবি এবং মাহমুদ যৌথভাবে সাবেক স্বাস্থ্য সচিবকে দিয়ে বিশেষ কিছু বদলি আদায় করান। প্রতিটি বদলিতে তারা আদায় করেন ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। এভাবে ধীরে ধীরে তাদের সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে, যেটি পুরো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বদলি-নিয়োগ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।

এতোসব অভিযোগের পর ২১ এপ্রিল সরকারি আদেশে মোয়াজ্জেম হোসেন এবং তুহিন ফারাবিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। যদিও মোয়াজ্জেম দাবি করেন, তিনি পদত্যাগ করেছেন ব্যক্তিগত কারণে। তিনি বলেন, তার সামনে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং পিএসসির মৌখিক পরীক্ষা রয়েছে, সে কারণেই পদত্যাগ করেছেন।

তিনি আরও বলেন, “আমি এক টাকার দুর্নীতি করেছি কেউ তা প্রমাণ করতে পারবে না।” অথচ তার বিরুদ্ধে ফাঁস হওয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে ৪০০ কোটি টাকার তদবির বাণিজ্যের হিসাব। প্রশ্ন হলো, যদি সত্যিই এসব অভিযোগ মিথ্যা হয়, তাহলে কেন রাষ্ট্রের এত গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে তাকে অপসারণ করা হলো?

যেসব কর্মকর্তারা এখনও সরকারে রয়েছেন, তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন—মোয়াজ্জেম, তুহিন, মাহমুদেরা সরকারি অফিসে গিয়ে বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অবস্থান করতেন। সচিবালয়ে রাতের এই 'অপারেশন' যেন ছিল রীতিমতো গোপন দুর্নীতির আখড়া।

মোয়াজ্জেম সেগুনবাগিচার গণপূর্ত অধিদপ্তরে সন্ধ্যার পর গিয়ে বদলির তালিকা করতেন। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা ও বিভাগীয় শহরে প্রকৌশলী বদলির জন্য তালিকা তৈরি হতো রাতে। একেকটি বদলিতে দিতে হতো লাখ লাখ টাকা। যারা রাজি হতেন না, তাদেরকে হুমকি দেওয়া হতো কিংবা চাকরিজীবনে পিছিয়ে পড়ার ভয় দেখানো হতো।

তুহিন ফারাবির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী ডা. মাহমুদুল হাসান বর্তমানে রাশিয়ায় রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে থেকে আদায় করা বিপুল পরিমাণ অর্থ রাশিয়ায় পাচার করেছেন। গত বছর ৫ আগস্টের পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং তুহিনের তদবিরে মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ পান।

বর্তমানে তিনি একজন রোগীর সঙ্গে রাশিয়ায় অবস্থান করছেন বলে দাবি করা হলেও, বাস্তবে তার আর বাংলাদেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। একাধিক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার মতে, "তিনি জানতেন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে, তাই আগেভাগেই পালিয়েছেন।"

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—এতোসব অভিযোগ যখন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, তখন সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টারা কী ভূমিকা নিচ্ছেন? স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম—তাদের নিয়োগপ্রাপ্ত এপিএস ও পার্সোনাল অফিসারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও তারা প্রকাশ্যে কোনো অবস্থান নেননি।

এর ফলে জনমনে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে যে উপদেষ্টারাই হয়তো এসব কর্মকাণ্ডে মৌন সম্মতি দিয়েছেন বা অন্তত চোখ বন্ধ করে রেখেছেন। যাদের দায়িত্ব ছিল সরকারের দুর্নীতিমুক্ত রূপ তুলে ধরা, তারাই যদি এমন চক্রের পৃষ্ঠপোষক হন, তাহলে সাধারণ মানুষের আশাভরসা কোথায়?

এই প্রতিবেদন কোনো কল্পকাহিনি নয়। এটি একটি চলমান দুর্নীতির চিত্র, যেখানে নতুন নাম, নতুন মুখ, নতুন সরকার—সবকিছু মিলেও পুরনো দুর্নীতির চক্রের বাইরে যেতে পারেনি।

যখন জনগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছিল, তখন তারা আশা করেছিল—অন্তত একবার একটা দলীয় রাজনীতিমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন দেখা যাবে। কিন্তু মোয়াজ্জেম, তুহিন, মাহমুদের মতো ব্যক্তিরা সেই আশাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি সত্যিই এই তদবির সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে? নাকি আবারও নতুন মুখে পুরনো নাটকের পুনরাবৃত্তি হবে?

আমরা জনতার পক্ষ থেকে চাই—সুষ্ঠু তদন্ত হোক, বিচার হোক এবং যারা রাষ্ট্রের আস্থা ভেঙেছেন, তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।


লেখক পরিচিতি: আবদুল্লাহ আল মামুন একজন অনুসন্ধানধর্মী রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট, যিনি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অসঙ্গতি নিয়ে লেখালেখি করেন।

Ingen kommentarer fundet