close

ভিডিও আপলোড করুন পয়েন্ট জিতুন!

ঢাকার শেষ লড়াই: আত্মসমর্পণ আর স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। ঢাকা তখন উত্তাল, ধ্বংসস্তুপ আর আতঙ্কে ভরা। মার্কিন সাংবাদিক পিটার আর কান সেই সময়ে ঢাকায় ছিলেন। সংবাদ পাঠানোর সুযোগ না থাকায় তিনি একটি দিনপঞ
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। ঢাকা তখন উত্তাল, ধ্বংসস্তুপ আর আতঙ্কে ভরা। মার্কিন সাংবাদিক পিটার আর কান সেই সময়ে ঢাকায় ছিলেন। সংবাদ পাঠানোর সুযোগ না থাকায় তিনি একটি দিনপঞ্জি লেখা শুরু করেন। সেই দিনপঞ্জির চুম্বক অংশ পরে দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল-এ প্রকাশিত হয়। তাঁর এই ঐতিহাসিক প্রতিবেদনের জন্য ১৯৭২ সালে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করেন। এই রিপোর্টের মাধ্যমে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের শেষ কয়েক দিনের অগ্নিগর্ভ চিত্র। সোমবার, ১৩ ডিসেম্বর: ঢাকায় সকাল থেকে কারফিউ উঠিয়ে নেওয়ার পর শহরের কেন্দ্রে যান পিটার। শহরের বেশিরভাগ বাঙালিরা চলে গেছেন, রাস্তায় শুধু বিহারিরা আর রিকশাচালকেরা। পাকিস্তানি পতাকার সংখ্যা তখন কমে এসেছে। কূটনীতিকদের মতে, ঢাকায় তখন "প্রতিটি সেলাই মেশিন ব্যস্ত বাংলাদেশের পতাকা বানাতে।" পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল এ এ কে নিয়াজি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধ কীভাবে চলছে? “যেভাবে আমি পরিকল্পনা করেছি।” আপনি কি শহর রক্ষা করতে পারবেন? “শেষ পর্যন্ত।” কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বরে ছিল অনিশ্চয়তার সুর। আশপাশে থাকা বিহারিরা "পাকিস্তান জিন্দাবাদ" বলে চিৎকার করছিল। আর রিকশার প্যাডেলে মাথা নিচু করে চালাচ্ছিলেন বাঙালি চালকেরা। মঙ্গলবার, ১৪ ডিসেম্বর: শহরের কেন্দ্রীয় গভর্নর হাউসে ভারতীয় যুদ্ধবিমানের আক্রমণ শুরু হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকার খুব কাছেই পৌঁছে গেছে—মাত্র সাত মাইল দূরে। ভারতীয় যুদ্ধবিমান থেকে শহরে লিফলেট ছড়ানো হচ্ছিল, যেখানে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। “আত্মসমর্পণ করুন, জীবন ও সম্পদ রক্ষা করুন।” গভর্নর এ এম মালিক পদত্যাগ করেন। জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা জানান, পদত্যাগপত্র লেখার সময় মালিক দুইবার বিমান হামলার মধ্যেও নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেন। পাকিস্তানি শীর্ষ সেনারা তখনও আত্মসমর্পণকে অসম্ভব বলে প্রচার করতে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ঢাকার খাবারের মজুত ফুরিয়ে আসছিল। দোকানগুলো বন্ধ, দরিদ্রদের জন্য খাদ্য কেনা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। বুধবার, ১৫ ডিসেম্বর: পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। হোটেলের গেটে জেনারেল রাও ফরমান আলী উপস্থিত হন। তাঁকে ঘিরে স্থানীয়দের চিৎকার: “কসাই, খুনি, জারজ।” একটি দৃশ্য ছিল উল্লেখযোগ্য: “সেনাবাহিনীর চিকিৎসক বলেন, ‘সম্মানের নামে আর কত আত্মত্যাগ করতে হবে? ১০ লাখ মানুষ কি মরতে হবে?’” বিকেলে শহরের ভেতরে রক্তাক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখা যায়। হোটেলের ম্যানেজাররা হতাশ কণ্ঠে বলেন, “আমার চেয়ারগুলো তাঁর রক্তে ভিজে গেল।” বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর: সকাল থেকে উত্তেজনা। ভারতীয় জেনারেল নাগরা ও ব্রিগেডিয়ার ক্লের ঢাকার উপকণ্ঠে প্রবেশ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের আলোচনা চূড়ান্ত হয়। বিকেলে গলফ কোর্সে ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। জেনারেল নিয়াজি হাতের লেখাগুলো এক এক করে পড়ছিলেন, যেন এটি তাঁর জন্য নতুন কিছু। স্বাক্ষরের পর জনতার উল্লাসে সব কিছুই বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। কেউ ভারতীয় সেনাদের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন, কেউ আবার পাকিস্তানি কমান্ডারদের উদ্দেশে চিৎকার করছেন। জেনারেল রাও ফরমানকে ঘিরে মানুষ যখন ক্ষোভে ফুঁসে উঠছিল, তিনি বিড়বিড় করে বলেছিলেন, “আপনারা কি জানেন না, আপনাদের জন্য আমি কী করেছি?” কিন্তু তখন আর সেই কথা শোনার সময় ছিল না। বিজয়ের আনন্দে সবাই আত্মহারা হয়ে পড়েছিল। উপসংহার: পিটার আর কানের দিনপঞ্জির এই চিত্রই তুলে ধরে সেই সময়ের ঢাকার বাস্তবতা—একদিকে পাকিস্তানিদের ভাঙা মনোবল, অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত বিজয়ের দৃঢ় অঙ্গীকার। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে ঢাকার আকাশে উঠে যায় বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা।
Inga kommentarer hittades