দেশের পুঁজিবাজার বর্তমানে চরম অস্থিরতার মুখে। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-এ দাবানলের গতিতে দরপতন অব্যাহত রয়েছে, যার ফলে বাজারের প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স (DSEX) ৪ হাজার ৯৮৬ পয়েন্টে নেমে এসেছে। এই পতনের ফলে গত চার মাসের মধ্যে এই প্রথম সূচকটি ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে নামল, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির এবং পুঁজি উধাও হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।
চলতি সপ্তাহজুড়ে ডিএসই'র সমস্ত সূচক নিম্নমুখী প্রবণতায় ছিল। প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স সপ্তাহ শেষে ১৫৪.২৮ পয়েন্ট বা ৩.০১ শতাংশ কমেছে। অন্যান্য সূচকগুলোর মধ্যে ডিএসই-৩০ সূচক কমেছে ২.৩৭ শতাংশ এবং ডিএসইএস সূচক কমেছে ৪.০১ শতাংশ। এই টানা দরপতনের ফলে সপ্তাহ ব্যবধানে ডিএসইর বাজার মূলধন থেকে ৮ হাজার ৬৩২ কোটি টাকার বেশি অর্থ বিলীন হয়ে গেছে।
এক কার্যদিবসের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, লেনদেন শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাজারের চিত্র পাল্টে যায়। দিনের শেষে মাত্র ৭০টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়লেও, বিপরীতে ২৬৭টি প্রতিষ্ঠানের দর কমে গেছে। এই পরিস্থিতি বাজারের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারানোর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।
পুঁজিবাজারের এই তীব্র দরপতনের পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলেছে সম্প্রতি একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় থাকা পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে ঘিরে সৃষ্ট সংকট। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করেছে যে, দুর্বল আর্থিক পরিস্থিতির কারণে এই পাঁচটি ব্যাংকের (ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক) শেয়ারহোল্ডাররা কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন না। এর অর্থ হলো, এসব ব্যাংকের শেয়ারের মূল্য কার্যত শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ঘোষণার পরপরই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন স্থগিত করে। তবে শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিএসইসি বেশ বিলম্ব করেছে, ফলে অনেক বিনিয়োগকারী নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
পুঁজিবাজারের এমন নাজুক পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নীতি নির্ধারকদের প্রতি কঠোর বার্তা দিয়েছেন ব্যবসায়িক নেতারা। বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতি (বিএপিআই) এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-এর মধ্যে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় বৈঠকে শিল্প নেতারা নীতির ধারাবাহিকতার ওপর জোর দেন।
-
নীতির স্থিতিশীলতা: বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির নেতারা মন্তব্য করেছেন, দেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি আস্থা ফিরিয়ে আনতে নীতি, আইন ও বিধিমালায় ঘন ঘন পরিবর্তন বন্ধ করা এবং স্থিতিশীল কর কাঠামো বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
-
তালিকাভুক্তির প্রণোদনা: ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার অতালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রায় সমান হওয়ায়, কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তির প্রণোদনা কমে গেছে।
-
স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: নেতারা মনে করেন, সরকারের উচিত বিনিয়োগ সম্পর্কিত নীতিমালা স্থিতিশীল রাখা এবং কোনো বিষয়ে পরিবর্তন আনা হবে না, তা স্পষ্ট ঘোষণা করা। পাশাপাশি, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।
-
সৎ উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ: ডিএসই পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন মন্তব্য করেন যে, বাজারে যদি ভালো উদ্যোক্তারা না আসেন, তবে দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো সুযোগ নেবে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলা যায়, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখন এক কঠিন সময় পার করছে। একদিকে বৈশ্বিক অর্থনীতির দুর্বলতা, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণভাবে ব্যাংক একীভূতকরণের মতো বড় সংকটের সরাসরি প্রভাব। এই অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং নীতিনির্ধারকদের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ এবং স্থিতিশীল নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরি, যা সৎ ও সক্ষম উদ্যোক্তাদের বাজারে আকর্ষণ করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারে।



















