close

লাইক দিন পয়েন্ট জিতুন!

ড. মুহাম্মদ ইউনুসের রিসেট বাটন বিতর্ক ইতিহাস বিকৃতি না বিবেক পুনর্জাগরণ?..

Sampadakiya Anuchchhed avatar   
Sampadakiya Anuchchhed
ড. মুহাম্মদ ইউনুসের "রিসেট বাটন" বিতর্ক বাংলাদেশে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সমর্থকদের মতে, এটি একটি ন্যায়ভিত্তিক অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের ডাক—যেখানে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও সাম্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা..

ড. মুহাম্মদ ইউনুসের রিসেট বাটন বিতর্ক ইতিহাস বিকৃতি না বিবেক পুনর্জাগরণ?

ড. মুহাম্মদ ইউনুসের "রিসেট বাটন" মন্তব্যের প্রেক্ষিতে যে বিতর্ক ও সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে, তা কেবল একটি ব্যক্তিগত মতামতের প্রতিক্রিয়া নয়; বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার একটি গভীর প্রতিফলন। 

এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব, কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাসকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে বিভ্রান্তি ও বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে, এবং কেন ড. ইউনুসের মন্তব্যকে সেই প্রেক্ষাপটে পুনর্বিবেচনা করা জরুরি।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ছিল একটি জাতির জন্য গর্বের বিষয়। তবে, স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী ৫৪ বছরে আমরা দেখেছি, কীভাবে এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাসকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে।

এমনকি এই সময়ের মধ্যে, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নে দলীয়করণ, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলা, এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে রাজনৈতিক প্রচারণায় ব্যবহার- সব মিলিয়ে একটি আদর্শকে ব্যবহারের মাধ্যমে তা থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে। 

অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আজ অবহেলিত, চিকিৎসাহীন, সমাজের পাশে পরিত্যক্ত। আর যারা কখনো মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিল না, তারা চেতনার দাবিদার হয়ে ক্ষমতার চূড়ায় উঠে এসেছে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি রাজনৈতিক ব্র্যান্ডে রূপান্তরিত হয়েছে।

ড. ইউনুসের "রিসেট বাটন" মন্তব্যটি কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের অস্বীকৃতি নয়; বরং এটি ছিল একটি প্রতীকী আহ্বান। সেই আহ্বান ছিল গণতন্ত্রের চর্চা, স্বাধীন মত প্রকাশ এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। তার বক্তব্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বোঝার বদলে তাকে রাজাকার, দালাল, দেশদ্রোহী ইত্যাদি শব্দে আক্রমণ করা হয়েছে- যা আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতিও এক ধরনের হুমকি।

তিনি ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়েই তিনি অর্থ, জনমত ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি যে সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়েছেন, তা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত হয়েছে। 

এক ব্যক্তি যখন দেশের সবচেয়ে উপেক্ষিত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়ান, তখন তাকে শুধু একটি ভুল ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে কলঙ্কিত করা একটি জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ।

এখানে একটি গভীর প্রশ্ন আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়- যদি কেউ সত্যিই ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়, তবে সেই ইতিহাস কি এতটাই দুর্বল যে একটি প্রতীকী শব্দেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে? নাকি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শত্রু আসলে তারা, যারা ইতিহাসকে ব্যবসায়িক পণ্যে রূপান্তর করে নিজেরা লাভবান হয়েছে এবং অন্যদের চুপ করিয়ে দিয়েছে?

 রাশিয়ান লেখক নিকোলাই অস্তভস্কি তাঁর "ইস্পাত" বইয়ে উল্লেখ করেছেন, "স্বাধীনতা রক্ষার চেয়ে ধরে রাখা কঠিন।" তিনি এক কর্নেলের কথা বলেন, যিনি সারা জীবন দেশসেবায় ছিলেন, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে একটি নারকীয় অপরাধের কারণে তার সব অর্জন হারিয়ে যায়। এই উপমাটি আমাদের শেখায়- নৈতিকতা প্রতিদিনের অনুশীলন; একবার অর্জন করলেই তা চিরস্থায়ী হয় না।

বাংলাদেশের রাজনীতি অনেকাংশে এখন সেই ভুল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, যেখানে চেতনা রক্ষা নয়, বরং তার ব্যবহার হয় ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য। রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ইতিহাসের ব্যবহারে শুধু বিভ্রান্তি বাড়ে, জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠে না। কেউ প্রশ্ন তুললেই যদি তাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে স্বাধীনতার প্রকৃত উদ্দেশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

যদি আমরা সত্যিই চেতনার ধারক হই, তাহলে সেটি প্রমাণ করতে হবে সহনশীলতা, সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আসল শক্তি হলো অন্তর্ভুক্তি, প্রতিহিংসা নয়। সেখানে প্রশ্ন তোলা মানে দেশবিরোধিতা নয়, বরং একটি সমাজের আত্মবিশ্লেষণ।

ড. ইউনুস আমাদের সামনে সেই আত্মবিশ্লেষণের দরজাটি খুলে দিতে চেয়েছেন। তাঁর “রিসেট বাটন” মন্তব্যটি ছিল আমাদের রাজনৈতিক মূল্যবোধ পুনঃস্থাপনের আহ্বান- একটি ভিন্ন পথচলার প্রস্তাব, যেখানে ইতিহাসকে অস্বীকার নয় বরং সম্মান করে একটি ন্যায্য সমাজ গঠনের লক্ষ্যে যাত্রা করা যায়।

আমরা যদি সত্যিই স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাস করি, তাহলে আমাদের উচিত সেই চেতনার প্রতিফলন ঘটানো ব্যক্তি ও চিন্তার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করার মানসিকতা ছাড়া কোনো জাতি টেকসই মুক্তি লাভ করতে পারে না।

অতএব, সময় এসেছে এই সমাজে সত্যিকার অর্থে "রিসেট" করার- ইতিহাস নয়, আমাদের বিবেক।

 আমার প্রবন্ধে অন্তবর্তী কালীন সরকারের প্রধান ড. মো. ইউনুসের বিতর্কিত করা শব্দ “রিসেট বাটন” মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনৈতিক কৌশল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে একটি সমন্বিত আলোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রবন্ধটি প্রমাণ করে, ইতিহাসকে সম্মান করতে হলে তাকে কেবল স্মরণ করলেই হবে না—তাকে ন্যায়ের পক্ষে ব্যবহার করতে হবে। অন্যথায় ইতিহাস একটি শব্দমাত্র, যার মধ্যে আত্মা নেই।

"Those who wear the mask of ideals while trading on history are not just betrayers of the past—they are the most dangerous deceivers of the future."

Keine Kommentare gefunden