বিশ্বের পরিবহন শিল্পে এক নতুন যুগের সূচনা হতে চলেছে। দীর্ঘ আট বছরের পরিকল্পনা এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের পর, প্রযুক্তি বিশ্বের স্বপ্নদ্রষ্টা ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান টেসলা অবশেষে তাদের সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ট্যাক্সি সেবা—‘রোবোট্যাক্সি’—বাজারে এনেছে। গত ১১ই অক্টোবর, ২০২৪ সালে যাত্রা শুরু করা এই সেবাটি শুধুমাত্র উবার, লিফট বা গুগলের ওয়েমোর মতো রাইড-শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেনি, বরং এটি টেসলার গাড়ি বিক্রিকে উৎসাহিত করার এক অভিনব এবং সুদূরপ্রসারী কৌশলের অংশ, যা অ্যাপলের সফল ইকোসিস্টেম মডেল দ্বারা অনুপ্রাণিত।
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের প্রথমে উবার এবং গুগলের ওয়েমোর ব্যবসায়িক মডেল বুঝতে হবে। ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করা উবার মূলত একটি ‘মার্কেটপ্লেস মডেল’-এর ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা নিজেরা কোনো গাড়ি কেনে না বা চালকদের চাকরি দেয় না; বরং তারা চালক এবং যাত্রীর মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন করে দেয় এবং প্রতিটি রাইড থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ কমিশন আয় করে। এই মডেলের কারণে উবার খুব কম বিনিয়োগে দ্রুত বিশ্বজুড়ে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পেরেছে।
অন্যদিকে, গুগল তাদের স্বয়ংক্রিয় গাড়ি প্রকল্প ‘ওয়েমো’-র জন্য এক ভিন্ন এবং ব্যয়বহুল পথ বেছে নিয়েছে। তারা তাদের গাড়িতে অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং দামী ‘লাইডার’ (LiDAR) সেন্সর ব্যবহার করে, যা দিয়ে একটি নির্দিষ্ট এলাকার (জিও-ফেন্সড) বিস্তারিত ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি করা হয়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ওয়েমোর গাড়িগুলো অত্যন্ত নির্ভুলভাবে চলতে পারলেও, এর দুটি বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, প্রতিটি নতুন শহরে ব্যবসা শুরু করার আগে সেই শহরের বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। দ্বিতীয়ত, গাড়িগুলোর মালিকানা গুগলের নিজের হওয়ায় এর পরিচালন খরচ অনেক বেশি, যার ফলে এটি এখনও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি।
এখানেই টেসলা এবং ইলন মাস্ক এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছেন। টেসলার স্বয়ংক্রিয় গাড়ি শুধুমাত্র ক্যামেরা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) ওপর নির্ভর করে চলে, ঠিক যেমন মানুষ তার চোখ এবং মস্তিষ্ক ব্যবহার করে গাড়ি চালায়। এই ‘ক্যামেরা-অনলি’ পদ্ধতি টেসলাকে এক অবিশ্বাস্য সুবিধা দিয়েছে। ওয়েমোর মতো তাদের কোনো নির্দিষ্ট শহরের মানচিত্র তৈরির প্রয়োজন হয় না; বিশ্বের যেকোনো রাস্তায় থাকা লক্ষ লক্ষ টেসলা গাড়ি প্রতিনিয়ত যে ডেটা সংগ্রহ করছে, তা দিয়েই তাদের AI আরও উন্নত হচ্ছে। এর ফলে, টেসলার রোবোট্যাক্সি যেকোনো শহরে বা দেশে মুহূর্তের মধ্যে তাদের সেবা চালু করতে পারে, যা স্কেলেবিলিটির দিক থেকে এক বিশাল লাফ।
তবে, টেসলার রোবোট্যাক্সির মূল লক্ষ্য উবারকে ধ্বংস করা নয়, বরং টেসলার গাড়ি বিক্রিকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যা অন্য কোনো গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কল্পনাও করতে পারে না। টেসলার পরিকল্পনা অনুযায়ী, একজন টেসলা গাড়ির মালিক যখন তার গাড়িটি ব্যবহার করবেন না, তখন তিনি সেটিকে রোবোট্যাক্সি নেটওয়ার্কে যুক্ত করে দিতে পারবেন। এর ফলে, গাড়িটি নিজে থেকেই যাত্রী পরিবহন করে মালিকের জন্য অর্থ উপার্জন করবে। ইলন মাস্কের মতে, এই আয়ের মাধ্যমে একজন মালিকের গাড়ির মাসিক কিস্তির খরচ উঠে যাবে এবং গাড়ি কেনাটা একটি লাভজনক বিনিয়োগে পরিণত হবে। ঠিক যেমন অ্যাপল তাদের আইফোন, অ্যাপ স্টোর এবং অন্যান্য সেবা দিয়ে একটি শক্তিশালী ইকোসিস্টেম তৈরি করেছে, টেসলাও তাদের গাড়ি, চার্জিং নেটওয়ার্ক এবং রোবোট্যাক্সি সেবা দিয়ে একটি অপ্রতিরোধ্য ইকোসিস্টেম তৈরি করতে চলেছে।
রোবোট্যাক্সির পরিচালন খরচ এতটাই কম যে, এটি উবার বা ওয়েমোর ভাড়ার চেয়ে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় গুণ কমে যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, যে দূরত্বের জন্য উবারের খরচ ১৮-৩১ ডলার এবং ওয়েমোর খরচ ২২-২৬ ডলার, সেখানে রোবোট্যাক্সির খরচ মাত্র ৩.৭১ ডলার। ইলন মাস্কের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ভবিষ্যতে এই খরচ গণপরিবহনের চেয়েও কমে আসবে।
টেসলার রোবোট্যাক্সি শুধুমাত্র একটি ট্যাক্সি সেবা নয়, এটি পরিবহন এবং লজিস্টিক শিল্পে এক আসন্ন বিপ্লবের প্রথম ধাপ। স্বয়ংক্রিয় গাড়ির মাধ্যমে লাস্ট-মাইল ডেলিভারি থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহন—সবকিছুই বদলে দেওয়ার এক বিশাল পরিকল্পনার অংশ এটি। এই প্রযুক্তি যদি সফল হয়, তবে তা শুধুমাত্র উবার বা গুগলের জন্যই নয়, বরং বিশ্বের পুরো অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোর জন্যই এক বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসবে।



















