close

ভিডিও দেখুন, পয়েন্ট জিতুন!

চাকরি নয়, দায়িত্ব রাষ্ট্রের মালিক কে?

Bokhtiar Shamim avatar   
Bokhtiar Shamim
যে রাষ্ট্র তার নাগরিকের করের টাকায় চলে, সেখানে নাগরিকই তো মালিক। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে অনেক সরকারি চাকরিজীবী যেন প্রজাতন্ত্রের চাকরি না করে রাজত্ব করতে এসেছে। কিছু আইনের প্রয়োগ যখন নিজ গায়ে ..

 

যে রাষ্ট্র তার নাগরিকের করের টাকায় চলে, সেখানে নাগরিকই তো মালিক। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে অনেক সরকারি চাকরিজীবী যেন প্রজাতন্ত্রের চাকরি না করে রাজত্ব করতে এসেছে। কিছু আইনের প্রয়োগ যখন নিজ গায়ে এসে পড়ে, তখনই দেখা যায় প্রতিবাদের ঝড়। অথচ প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি যদি অন্যায় না করেন, তাহলে আইনের ভয় আপনার কেন?

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরি এক ধরণের ক্ষমতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ক্ষমতার অপব্যবহার নতুন কিছু নয়। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় দুর্নীতির অভিযোগ, ঘুষের খবর, নাগরিককে হয়রানির গল্প। অথচ সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণের সেবক। কিন্তু যারা সেবক হওয়ার কথা, তারা যখন শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন রাষ্ট্রের কাঠামোই বিকৃত হয়।

 

সম্প্রতি এক আইনের ধারার বিরুদ্ধে যেভাবে কিছু সরকারি চাকরিজীবী রাজপথে নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছে, তা গভীর প্রশ্নের জন্ম দেয়। আইন বলছে, চাকরিজীবী যদি দায়িত্ব পালনে অনিয়ম, দুর্নীতি বা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তাদের চাকরি যেতে পারে। এই আইন কি অন্যায়? যদি কেউ চুরি না করেন, ঘুষ না খান, ক্ষমতার অপব্যবহার না করেন—তবে তারা আতঙ্কিত হচ্ছেন কেন?

 

এই প্রশ্ন নতুন নয়। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব আইন অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করে, সেগুলো সম্পর্কে জানলে বোঝা যায়, আইন মানেই প্রতিশোধ নয়, বরং ন্যায়বিচারের গ্যারান্টি। 

 

যেমন:

সৌদি আরবে চুরির শাস্তি হিসেবে হাত কেটে দেয়া হয়। আইনটি কঠিন, কিন্তু চুরি কমাতে ভূমিকা রেখেছে।

চীন ও উত্তর কোরিয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইন এতটাই কঠোর যে অনেক সময় মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত কার্যকর করা হয়।

 

সিঙ্গাপুরে ঘুষের শাস্তি এত কঠিন যে সরকারি কর্মকর্তা দুর্নীতি করতে ভয় পান।

এসব দেশ প্রমাণ করেছে যে, কঠিন আইন অপরাধ কমাতে পারে যদি তার প্রয়োগ সঠিক হয়। তাহলে প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে যদি এমন একটি আইন থাকে যা অপরাধ করলে চাকরি চলে যাবে, তবে তা অন্যায় কীভাবে?

 

বাংলাদেশে দুর্নীতির চিত্র ভয়াবহ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি অফিস, পুলিশ বিভাগ—সবখানেই সাধারণ মানুষকে ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

 

সরকারি চাকরিজীবীরা অনেক সময় এমনভাবে আচরণ করেন যেন তারা নাগরিকের নয়, রাষ্ট্রের মালিক। তারা মনে করেন, এই চাকরি চিরস্থায়ী, এখান থেকে কেউ তাদের সরাতে পারবে না। অথচ বিশ্বের অধিকাংশ আধুনিক রাষ্ট্রে সরকারি চাকরি পারফরম্যান্সের উপর নির্ভরশীল।

 

আমেরিকায় সরকারি চাকরিজীবী যদি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন বা কর্মদক্ষতায় ব্যর্থ হন, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। জাপানে সরকারি কর্মকর্তা জনগণের সামনে দায়বদ্ধ থেকে কাজ করেন। এমনকি সুইডেনে যেকোনো নাগরিক চাইলে সরাসরি সরকারি অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে পারেন এবং প্রশাসন বাধ্যতামূলকভাবে তা বিবেচনা করে।

 

বাংলাদেশে যখন সরকারি চাকরিজীবীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখনই শুরু হয় প্রতিরোধ। মনে রাখতে হবে, এ দেশে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। তারা তাদের কষ্টার্জিত আয়ে কর দেয়, সেই টাকায় বেতন পান সরকারি চাকরিজীবীরা। তাহলে সেই জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে আপত্তি কিসের?

 

এই আইনের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছেন, তারা কি নিশ্চিত করতে পারবেন যে তারা কখনও অনিয়ম করেননি? যদি কেউ চুরি না করেন, তাহলে তার হাত কাটার ভয় থাকার কথা না। আপনি যদি ঘুষ না খান, তাহলে চাকরি যাওয়ার শঙ্কা কেন?

 

এই জায়গায় এসে প্রশ্ন ওঠে—আইন কার জন্য? শাসকের জন্য, না সেবকের জন্য? এবং সেই আইন প্রয়োগে কি সব পক্ষ সমান দায়বদ্ধ? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে আইনের শাসন এখনো অনেকাংশেই পক্ষপাতদুষ্ট। রাজনৈতিক পরিচয়, প্রভাব, অর্থবল—এসবের প্রভাবে অনেক অপরাধী শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যায়। 

 

তবু যখন একটি উদ্যোগ আসে যাতে সকল সরকারি কর্মচারী একই আইনের আওতায় আসে, তখন তার বিরোধিতা মানে কি এই নয় যে, তারা নিজেদের অপরাধ ঢাকতে চাইছেন?

 

একটি রাষ্ট্রে আইন থাকতে হবে। এবং সেই আইন যেন কেবল সাধারণ মানুষের জন্য না হয়ে, সকল শ্রেণীর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হয়—এই হোক আমাদের দাবি। সরকারি চাকরি শুধু পেশা নয়, এটা একটি দায়িত্ব, একটি সেবা। যারা সেবা না দিয়ে শাসন করছেন, তারা আসলে প্রজাতন্ত্রের বিশ্বাসঘাতক।

 

প্রশ্ন শুধু একটি আইনের না, প্রশ্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গির। রাষ্ট্র মানে শুধু সরকার নয়, রাষ্ট্র মানে জনগণ। এবং সেই জনগণই যখন রাষ্ট্রের কাছে জবাব চায়, তখন সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা মানেই অপরাধ। এমন আইনের দরকার আছে, যেগুলো শুধু শাস্তি দেয় না, বরং অপরাধের পথ বন্ধ করে দেয়।

 

যারা আইনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামছেন, তারা আসলে নিজেদের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করছেন, না কি সত্যিকারের ন্যায়বিচার চান—এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে। এবং সেই উত্তর খোঁজার মধ্যেই লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ।

No se encontraron comentarios