close

কমেন্ট করুন পয়েন্ট জিতুন!

ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের ৫৫ বছর আজ: উপকূলবাসীর স্মৃতিতে এখনও রয়ে গেছে ১৯৭০ সালের সেই কালরাত্রি..

Md Hamidul Islam avatar   
Md Hamidul Islam
****

গলাচিপা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি:

আজ ১২ নভেম্বর — বাংলাদেশ ইতিহাসের এক শোকাবহ দিন। ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ৫৫ বছর পূর্তি। ১৯৭০ সালের এই দিনে (১২ নভেম্বর) বঙ্গোপসাগর উপকূলে আঘাত হেনেছিল বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়, যা মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল উপকূলীয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলের মানুষ।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর রাতে ঘণ্টায় প্রায় ২৪০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ও এর সঙ্গে ২০ থেকে ৩০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস একসঙ্গে আঘাত হানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলে। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রস্থল ছিল পটুয়াখালী, ভোলার মনপুরা, বরগুনা, চরফ্যাশন, দশমিনা, গলাচিপা, কুয়াকাটা, হাতিয়া, সন্দ্বীপসহ বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল।

মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারান—যা বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে স্বীকৃত। প্রাণ হারানো মানুষের অধিকাংশই ডুবে মারা যান ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাসে। অসংখ্য মানুষ নিখোঁজ হন, গবাদি পশু, ফসল ও ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।

ভোলার মনপুরা দ্বীপে প্রায় ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ এক রাতেই প্রাণ হারান। পুরো দ্বীপটাই মৃতদেহে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তখনকার সময়ে সঠিক উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম না থাকায় মৃতদেহগুলো সমাহিত করতেও দিন লেগে যায়। এখনও স্থানীয় প্রবীণরা বলেন, “সেই রাতে আকাশে চাঁদ উঠেছিল লাল রঙে, আর চারপাশে ছিল শুধু কান্নার শব্দ।”

দুর্যোগের প্রভাব ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক প্রাণহানি ও তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের উদাসীনতা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ক্ষোভকে চরমে তোলে। এই দুর্যোগের পরেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, যার প্রভাব পড়ে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে।বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘূর্ণিঝড় এবং তৎকালীন সরকারের অবহেলাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের গতি ত্বরান্বিত করেছিল।

অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পার হলেও পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, কুয়াকাটাসহ উপকূলীয় জনপদে এখনও অনেকে বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই দিনের দুঃসহ স্মৃতি। অনেকে হারিয়েছেন পুরো পরিবার, কেউ হারিয়েছেন জীবনের সবকিছু।

তবে সেই ভয়াবহ ঘটনার পর বাংলাদেশ সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। বর্তমানে উপকূলজুড়ে স্থাপন করা হয়েছে সাইক্লোন শেল্টার, আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও স্বেচ্ছাসেবক নেটওয়ার্ক, যার ফলে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়গুলোতে প্রাণহানি অনেকাংশে কমে এসেছে।

গলাচিপার এক প্রবীণ বাসিন্দা আব্দুল জলিল (৮৫) বলেন,
“সেদিন রাতে এমন বাতাস উঠেছিল যে, মনে হচ্ছিল পৃথিবী ভেঙে পড়ছে। জলোচ্ছ্বাসের পানিতে আমাদের পুরো গ্রাম হারিয়ে যায়। সকালে বেঁচে থাকা মানুষ গুনে দেখা গেলো, পুরো পরিবারে শুধু আমি একজন বেঁচে আছি।”

আজ ১২ নভেম্বর — বাংলাদেশের উপকূলবাসীর জন্য শোকের দিন। সেই ভয়াল ঘূর্ণিঝড় শুধু হাজারো প্রাণ কেড়ে নেয়নি, বরং রেখে গেছে এক গভীর শিক্ষা—প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার সংগ্রামের ইতিহাস।
৫৫ বছর পরও উপকূলের মানুষ প্রতি বছর এই দিনটি স্মরণ করে শোক, প্রার্থনা ও দোয়ার মধ্য দিয়ে।

No comments found


News Card Generator