বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে এক গভীর সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ও খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধির কারণে দেশের আর্থিক খাত চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এই সংকট নিরসনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘ব্যাংক রেজ্যুলেশন অ্যাক্ট’ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আগামী বছরের শুরুতেই বাস্তবায়ন করা হতে পারে। এই আইনের মূল লক্ষ্য হলো ব্যাংকগুলোর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ করা এবং প্রয়োজন হলে কিছু ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩.৪৫ ট্রিলিয়ন টাকা (২৮.৪ বিলিয়ন ডলার), যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২১% বেশি। এর ফলে, মোট ঋণের প্রায় ২০% এখন খেলাপি ঋণ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, নতুন মানদণ্ড কার্যকর হলে খেলাপি ঋণের হার আরও বৃদ্ধি পেতে পারে, যা মোট ঋণের প্রায় ৩০%-এ পৌঁছাতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “অতীতে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের স্বার্থ রক্ষায় খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ গোপন করা হতো। কিন্তু নতুন নীতিমালা চালুর ফলে প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে, যা ব্যাংকিং খাতের ভঙ্গুর অবস্থাকে স্পষ্ট করছে।”
অন্যদিকে, ঢাকার ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে. মুজেরি এই পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, "বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে। সময়মতো প্রয়োজনীয় সংস্কার না করলে পুরো ব্যাংক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।"
কেন বাড়ছে খেলাপি ঋণ?
খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান—
- নয় মাস থেকে ছয় মাসে এনপিএল শ্রেণিবদ্ধকরণের সময়সীমা কমানো : বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ শ্রেণিবদ্ধকরণের সময়সীমা নয় মাস থেকে ছয় মাসে নামিয়ে আনে। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়।
- রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও লুটপাট : অতীত সরকারগুলোর আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় বড় ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়েছিল, যা ফেরত আসেনি।
- নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতা : বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সময়মতো কঠোর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
- অনিয়ন্ত্রিত ঋণ পুনঃতফসিলকরণ : বারবার ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ থাকায় অনেক ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠান পরিকল্পিতভাবে ঋণ ফেরত না দিয়ে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে দায় এড়িয়েছে।
- ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা : রাষ্ট্রায়ত্ত এবং কিছু বেসরকারি ব্যাংকের ভেতরকার দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং লুটপাটের কারণে এই খাত আরও নাজুক হয়ে পড়েছে।
গত বছর, দেশের ব্যাংকিং সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু দুর্বল ব্যাংককে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা করেছিল। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এই উদ্যোগ থমকে যায়।
বর্তমানে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নতুন করে ব্যাংক পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। ‘ব্যাংক রেজ্যুলেশন অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করা হচ্ছে, যা কার্যকর হলে—
- দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ (merger)
- নতুন বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে ব্যাংকের পুনর্গঠন
- অস্থায়ী মালিকানা গ্রহণ
- ব্রিজ ব্যাংকের ব্যবস্থা
- প্রয়োজনে ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া
এই প্রক্রিয়া সহজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ছয়টি ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান পর্যালোচনা করছে এবং ধাপে ধাপে অন্যান্য ব্যাংকের ক্ষেত্রেও এই প্রক্রিয়া চালু করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ. মনসুর বলেন, "আমরা দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের চেষ্টা করব, নতুন বিনিয়োগকারী আনব এবং তাদের পুনর্গঠন করব। যদি প্রয়োজন হয়, কিছু ব্যাংক বন্ধও করা হতে পারে।"
তবে, এই প্রক্রিয়ায় কয়েকটি চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান—
- রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ : অতীতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক চাপের কারণে অনেক দুর্বল ব্যাংক বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
- জনগণের আস্থা সংকট : ব্যাংক বন্ধের গুজব ছড়িয়ে পড়লে আমানতকারীরা আতঙ্কিত হয়ে টাকা তুলতে শুরু করতে পারেন, যা পুরো ব্যাংকিং খাতের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
- প্রভাবশালী ঋণ খেলাপিদের প্রতিরোধ : অনেক বড় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ব্যাংকের ওপর দখলদারি বিস্তার করে রেখেছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হতে পারে।
- আন্তর্জাতিক চাপ : বাংলাদেশ বর্তমানে আইএমএফ-এর ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। এই কর্মসূচির শর্তানুযায়ী, খেলাপি ঋণ কমিয়ে ব্যাংকিং খাত সুসংহত করা বাধ্যতামূলক। ফলে, আইএমএফ-এর চাপেও সরকারকে কঠোর হতে হবে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত একটি নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসঙ্কেত। খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে হলে কেবল নতুন আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, বরং কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক বিবেচনা বাদ দিয়ে কঠোর আর্থিক শৃঙ্খলা আরোপ করা, দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ, এবং বড় ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া সংকট নিরসনের অন্য কোনো বিকল্প নেই।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বর্তমান পদক্ষেপগুলো যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে দেশের ব্যাংকিং খাত আবার স্থিতিশীল হতে পারে। তবে, যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক আপস বা দুর্বল প্রয়োগ এই সংস্কার প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ করে দিতে পারে, যা পুরো অর্থনীতির জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে।