বাড্ডা: উন্নয়নের আড়ালে এক ধ্বংসযজ্ঞের শহর

Sumon Hawlader avatar   
Sumon Hawlader
বাড্ডা, একসময় গ্রামীণ স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি, কিন্তু বর্তমানে নাগরিক দুঃস্বপ্নের এক ঘনঘটা। নগর জীবনের অসুযোগ, দখল, খুন আর ময়লায় অবস্থান করে বাড্ডা।..

সুমন হাওলাদারঃ 

আই নিউজ বিডি,  ২৮ মে ২০২৫।

একসময় গ্রামীণ স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি ছিল বাড্ডা, আজ তা নাগরিক দুঃস্বপ্নের এক ঘনঘটা। ঢাকার এই অংশটি এখন যেন শহরের এক অনিয়ন্ত্রিত, উপেক্ষিত এবং অসম্ভাব্য অধ্যায়। জ্যাম, মশা, মাদক, দখল, খুন আর ময়লা—এই শব্দগুলোই যেন এখন বাড্ডার সমার্থক হয়ে উঠেছে। বাড্ডার শিকড়ের রূপান্তর. যদিও 'বাড্ডা' নামের উৎপত্তি নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে (কেউ 'বদ্দা' নামক জমিদার পরিবার থেকে আসা বলেন, আবার কেউ বাইদানি বা বেদে সম্প্রদায়ের নাম থেকে), বাস্তবের বাড্ডা এখন শহরের গলার কাঁটা। পূর্বে বালু নদী আর পশ্চিমে সুবিশাল বিল ঘেরা বাড্ডা একসময় ছিল শান্ত কৃষিপ্রধান জনপদ। ধান, পাট ও সবজি ছিল এখানকার মানুষের জীবনধারণের প্রধান উৎস। নৌকা চলতো যে খাল ও জলাধার দিয়ে, আজ সেখানে উঠেছে দোকান আর দালান। খাল-জলাধারগুলো দখল হয়ে বাণিজ্যিক বস্তিতে পরিণত হয়েছে। সবুজ মাঠ আর খোলা জায়গার অভাবে নদীর নির্মল বাতাসও এখন অধরা। যা অবশিষ্ট আছে, তা কেবল দালান, জঞ্জাল আর নাগরিক বিভীষিকা। মধ্যবিত্তের স্বপ্ন, বাস্তবের যুদ্ধক্ষেত্র. নব্বইয়ের দশকে গুলশান-বনানীর উত্থানের সময় যখন ঢাকার ডেভেলপাররা জমির খোঁজে নামে, তখন বাড্ডা মধ্যবিত্তের শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। ফ্ল্যাট ও ভবন গজিয়ে ওঠে, কিন্তু নাগরিক সেবা রয়ে যায় অধরা। স্কুল আছে, কিন্তু শিক্ষার মান নেই। হাসপাতাল আছে, কিন্তু ওষুধের বদলে ‘প্রার্থনা’ই যেন সবচেয়ে কার্যকর। খেলার মাঠ নেই, ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকলেও পানি নামে না। গ্যাস, পানি ও নিরাপত্তার অভাব প্রকট; নিরাপত্তা শুধু সিসি ক্যামেরার ফুটেজে সীমাবদ্ধ। যা আছে, তা হলো—মশা, মাদক আর মানুষের আর্তনাদ। মাদকের অবাধ বাজার এতটাই উন্মুক্ত যে, 'ডোর টু ডোর' এবং 'ম্যান টু ম্যান, হ্যান্ড টু হ্যান্ড' পদ্ধতিতে মাদক কেনাবেচা চলছে। মশা যেন এখানকার একমাত্র নিয়মিত সরকারি প্রতিনিধি। উন্নয়নের নামে দুর্ভোগ ও দখলের মহোৎসব. বাড্ডার রাস্তা বছরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, যা উন্নয়নের নামে দুর্ভোগ আর নাগরিক ভোগান্তিকেই চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ফলস্বরূপ, ধুলো আর জলাবদ্ধতাই এখানকার নিত্যসঙ্গী। রাস্তায় হাঁটাও যেন কষ্টকর, চলাও দায়। সিলিন্ডার ছাড়া রান্না অচিন্তনীয়। খাল, জমি, সড়ক, ফুটপাত এবং এমনকি ফুট ওভারব্রিজও দখলের শিকার। দেখার যেন কেউ নেই। প্রতিদিন একটু একটু করে এই শহরের শ্বাসরোধ করছে দখলবাজরা। খাল সুপরিকল্পিতভাবে দখল হয়েছে, জমি দখল হয়েছে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায়, ফুটপাত চাঁদাবাজির ঠিকানা হয়েছে, সড়ক এখন অটোর দখলে, আর ফুট ওভারব্রিজ হকার ও হকার-সন্ত্রাসীদের দখলে। গোটা বাড্ডা এখন যেন এক 'ল্যান্ড গ্র্যাবিং ফেস্ট', আর প্রশাসন এক নীরব দর্শক। রাজনৈতিক গুরুত্ব ও নেতা-জনতার দূরত্ব. মেরুল বাড্ডা, দক্ষিণ বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, উত্তর বাড্ডা, পূর্ব বাড্ডা, শাহজাদপুর, সাতারকুল, আদর্শনগর, হোসেন মার্কেট, লিংক রোড, গুদারা ঘাট, টেকপাড়া, রূপনগর, সোনাকাটরা, মোল্লাপাড়া, বাগান বাড়ি, ময়নাটেক, ময়নার বাগ, আব্দুল্লাহবাগ, মিশ্রিতোলা, হাজীপাড়া এবং বেরাইদ—বাড্ডার এই বিস্তৃতি যেমন বিস্ময়কর, তেমনি রাজনৈতিকভাবেও 'গুরুত্বপূর্ণ'। ভোটের সময় নেতারা আসেন, ঈদের সময় তারা হাসেন। কিন্তু বছরের বাকি ৩৬৩ দিন? তখন তারা উন্নয়ন দেখেন দূরবীনে। এটি একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব। পরবর্তী পর্বগুলোতে বাড্ডার প্রতিটি পাড়া-মহল্লার আলাদা আলাদা ইতিহাস, সমস্যা এবং মানুষের জীবনের লড়াই তুলে ধরা হবে। আপনার মতে, বাড্ডার এই সামগ্রিক চিত্র কি কেবলই প্রশাসনিক ব্যর্থতার ফল, নাকি এর পেছনে আরও গভীর কোনো সামাজিক কারণ রয়েছে?

Ingen kommentarer fundet