২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা সাবেক শিবির নেতা

সুভাষ মজুমদার avatar   
সুভাষ মজুমদার
বগুড়ায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা আমিরুজ্জামান পিন্টুর বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর পাঁচ সহস্রাধিক নেতাকর্মীর প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হওয়ার অভিযোগ উঠেছে।..

বগুড়ায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা আমিরুজ্জামান পিন্টুর বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর পাঁচ সহস্রাধিক নেতাকর্মীর প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তিনি ‘রেইনবো মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান খুলে শরিয়াভিত্তিক অধিক মুনাফা দেওয়ার প্রলোভনে কষ্টার্জিত টাকাগুলো আত্মসাৎ করেন। ভুক্তভোগীরা ওই প্রতারকের প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি ঘেরাও করলেও তাকে খুঁজে পাননি।


সর্বস্বান্তদের একজন বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক ফজলুর রহমান জানান, টাকা ফেরত না পেলে আইনের আশ্রয় নেবেন।
ফোন বন্ধ থাকায় অভিযোগের ব্যাপারে অভিযুক্ত পিন্টুর কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।


অভিযোগ ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া শহরের মালগ্রাম মধ্যপাড়ার খন্দকারপাড়ার ডা. আবু জাফরের ছেলে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা আমিরুজ্জামান পিন্টু ফারইস্ট ইসলামী ইন্স্যুরেন্সে চাকরি করতেন। তিনি এ চাকরি ছেড়ে প্রায় এক যুগ আগে বগুড়া শহরের গালাপট্টিতে ‘রেইনবো মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ নামে প্রতিষ্ঠান খোলেন। এ ছাড়া রেইনবো হোমস, রেইনবো কৃষি উন্নয়ন সংস্থা ও শহরের কলোনি এলাকায় শেরপুর সড়কে রেইনবো হাসপাতাল চালু করেন।
পিন্টু বিদেশফেরত রেমিট্যান্সযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। তিনি শরিয়াভিত্তিক সুদমুক্ত অর্থনীতির কথা বলে ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছ থেকে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিতে শুরু করেন। পিন্টু সাবেক শিবির নেতা হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা বিশ্বাস করে তার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ শুরু করেন।

বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক মো. ফজলুর রহমান জানান, সাবেক শিবির নেতা আমিরুজ্জামান পিন্টু একজন প্রতারক। তিনি চাকরি থেকে অবসরের পর গত ২০১৬ সালের প্রথম দিকে পিন্টুর খপ্পরে পড়েন। শরিয়াভিত্তিক অধিক মুনাফা লাভের আশায় চার লক্ষাধিক টাকা বিনিয়োগ করেন। বিভিন্ন মেয়াদে লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে মুনাফা দিতেন। এতে বিশ্বাস করে ধর্মপ্রাণ মানুষ, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা বিনিয়োগ করেন।


সহযোগী অধ্যাপক মো. ফজলুর রহমান আরও জানান, পিন্টু তার ছাত্র হওয়ায় বিশ্বাস করে তিনি পর্যায়ক্রমে টাকা দিতে থাকেন। সর্বশেষ ২০২৩ সালে তিনি একবারে ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। তার স্ত্রী ও ছেলের কাছ থেকে এবং জমি বিক্রি করে পিন্টুর ‘রেইনবো মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ ও রেইনবো হোমস লিমিটেডকে টাকাগুলো দেন। তখন তার বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে তাকে সাত লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। এখনও তিনি ৮৩ লাখ টাকা পাবেন।
ওই সব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পিন্টু ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হামিদুল হক তোতা পাঁচ হাজারের বেশি গ্রাহকের কাছ থেকে অন্তত ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এরপর ২০২৪ সাল থেকে টাকা বা মুনাফা কোনোটাই ফেরত দিচ্ছেন না।


টাকা ফেরত দিতে চাপ দিলে তারা গত ১৫ মে তারিখ দেন। পাওনাদাররা টাকা নিতে পিন্টুর বাড়ি ও রেইনবো হাসপাতালে গেলে তিনি ২২ মে তারিখ দিয়ে তাদের ফেরত দেন। ওই দিন বাড়িতে গেলে সর্বশেষ ২ জুন টাকা ফেরত দেওয়ার সময় দেন।
এদিকে, ভুক্তভোগীরা ২ জুন বাড়িতে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করলেও পিন্টুকে পাননি। এরপর তারা শহরের কলোনি এলাকায় রেইনবো হাসপাতালে যান। সেখানেও তাকে পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তোতা মিয়াকে ঘেরাও করলে তিনি কিছু টাকা দিয়ে গাঢাকা দেন।
অপর বিনিয়োগকারী বগুড়া শহরের নারুলী এলাকার বুলু মিয়ার ছেলে বিদেশফেরত মো. ফয়সাল মন্ডল জানান, তিনিও শরিয়াভিত্তিক বিনিয়োগ বিশ্বাস করে পাঁচ বছর আগে পিন্টু ও তার লোকজনকে ৪০ লাখ টাকা দেন। তাকে মাসে ৬০ হাজার টাকা মুনাফা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এক বছর ধরে তাকে আর কোনও মুনাফা দেওয়া হচ্ছে না। মূল টাকা ফেরত দেওয়ার নামে তিন বছর ধরে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে।
অপর প্রবাসী নারুলী এলাকার রুহুল আমিনের ছেলে ববি দুই বছর আগে ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। তাকে মুনাফা দেওয়া হয়নি।


ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতারণার শিকার বিনিয়োগকারীরা জানান, শরিয়াভিত্তিক মুনাফার আশায় তারা পাঁচ সহস্রাধিক ব্যক্তির কষ্টার্জিত আয় প্রতারক সাবেক ছাত্রশিবির নেতা আমিরুজ্জামান পিন্টুর ‘রেইনবো মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’, ‘রেইনবো হোমস’, ‘রেইনবো কৃষি উন্নয়ন সংস্থা’ ও রেইনবো হাসপাতাল’-এ বিনিয়োগ করেছেন। এখন মূল টাকা বা মুনাফা কোনোটা না দিয়ে পিন্টু আত্মগোপন করেছেন। সর্বস্ব খুইয়ে এখন তারা টাকা ফেরত পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।


এ ব্যাপারে প্রতিকার পেতে থানা ও র‌্যাব কর্মকর্তার কাছে গেলেও তারা কোনও সহযোগিতা করেননি। ভুক্তভোগীরা তাদের টাকা ফেরত পেতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। প্রয়োজনে তারা আইনের আশ্রয় নেবেন।
এ প্রসঙ্গে বগুড়া শহর জামায়াতে ইসলামীর আমির আবিদুর রহমান সেহেল জানান, আমিরুজ্জামান পিন্টুর সঙ্গে জামায়াতের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে ৯০-এর দশকে ছাত্রশিবিরের কর্মী ছিলেন তিনি। শিবির থেকে যাওয়ার পর তিনি আর রাজনীতি করেননি।
জামায়াত নেতা আরও জানান, তার দলের পক্ষ থেকে বারবার এ ধরনের সমিতি বা এনজিওর সঙ্গে জড়িত না থাকতে বলা হয়েছে। তারপরও জড়িত হওয়া দুঃখজনক।
বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান বাসির জানান, তিনি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন, ভুক্তভোগীদের কথা শুনে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত কেউ মামলা করতে আসেননি। মামলা করলে তদন্তসাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Geen reacties gevonden


News Card Generator