বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পর এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। টানা দীর্ঘ সময়ের দমন-পীড়নের ইতিহাসের পরে এবার প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর জনদাবির মুখে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায়, সরকারের পতনের পর গত ১১ মাসে পুলিশের বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে ৭৬১টি মামলা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের সাম্প্রতিক এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে।
এই ৭৬১টি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে মোট ১১৬৮ জন পুলিশ সদস্যকে। তাদের মধ্যে ৬১ জনকে ইতোমধ্যেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। টিআইবির মতে, এটি একটি বড় পরিবর্তনের সূচনাবিন্দু, যদিও প্রকৃতপক্ষে জবাবদিহির যে কাঠামো তৈরি হওয়া প্রয়োজন, সেটি এখনও পর্যাপ্ত নয়। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, প্রশাসনিক বা বিভাগীয়ভাবে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও প্রকৃত বিচারিক অগ্রগতি সীমিত এবং ধীর।
সোমবার রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে টিআইবির নিজস্ব সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘নতুন বাংলাদেশ: কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন পরবর্তী এক বছরের ওপর পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ফেলো শাহজাদা এম আকরাম, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, মো. জুলকারনাইন এবং ফারহানা রহমানসহ আরও অনেকে।
শাহজাদা এম আকরাম বলেন, “ছাত্র-জনতার ওপর বর্বর হামলার ঘটনায় শুধু পুলিশ নয়, অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। যদিও সরকার কিছু প্রতীকী ব্যবস্থা নিয়েছে, কিন্তু প্রকৃত জবাবদিহির যে কাঠামো তৈরি হওয়া দরকার, তা এখনও গড়ে ওঠেনি।”
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত এক বছরে সারা দেশে মোট মামলা হয়েছে ১ হাজার ৬০২টি, যার মধ্যে ৬৩৮টি সরাসরি হত্যার অভিযোগে দায়ের করা হয়েছে। সাবেক সরকারদলীয় মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত ৮৭ জনকে। টিআইবির দাবি, এই মামলাগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশের তদন্তে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে এবং প্রায় ৬০ থেকে ৭০টি হত্যা মামলা এখন তদন্তের শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
গবেষণায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে— আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত এক বছরে ট্রাইব্যুনালের আওতায় ৪২৯টি অভিযোগ এবং ২৭টি মামলা গৃহীত হয়েছে। এসব মামলায় আসামি ২০৬ জন, যাদের মধ্যে ৭৩ জন ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়েছে, যদিও বিচারকার্যের গতি এখনও মন্থর।
ছাত্র ও জনতার আন্দোলনের সময়, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে যে সব হয়রানিমূলক মামলা দায়ের হয়েছিল, সেগুলোর প্রায় সবই এখন প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানান শাহজাদা এম আকরাম।
এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক জবাবদিহির জন্য একটি বড় বার্তা বহন করে। যদিও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তবে প্রথমবারের মতো আইনের চোখে পুলিশসহ ক্ষমতাসীন বাহিনীর সদস্যদের বিচারিক কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে—যা গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ রক্ষার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।