সাবেক মেটা কর্মচারীর চাঞ্চল্যকর স্বীকারোক্তি: সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম যেভাবে আমাদের মস্তিষ্ককে হ্যাক করে চলেছে, তা এখন মাদকের মতোই বিপজ্জনক। এআই-এর উত্থান এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে, যেখানে আমরা আসলে স্বাধীন নই, বরং বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানি এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ‘পকেটে থাকা স্পাইয়িং ডিভাইস’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
আজকের ডিজিটাল বিশ্বে আমাদের হাতে থাকা স্মার্টফোন কি শুধুমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম, নাকি এটি বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানি এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি অত্যাধুনিক নজরদারি যন্ত্র? সম্প্রতি ‘টু সেন্টস পডকাস্ট’-এ একজন সাবেক মেটা কর্মচারীর চাঞ্চল্যকর স্বীকারোক্তি এই প্রশ্নটিকে আবারও সামনে এনেছে। তার মতে, সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম যেভাবে আমাদের মস্তিষ্ককে ‘হ্যাক’ করে চলেছে, তা এখন মাদকের মতোই বিপজ্জনক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-এর উত্থান এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে, যেখানে আমরা আসলে স্বাধীন নই, বরং নিরন্তর নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণের শিকার। এই ঘটনাটি দেশের সামাজিক, প্রযুক্তিগত এবং এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনেও এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সাবেক মেটা কর্মচারী তার বক্তব্যে সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তিকে একটি ‘ড্রাগ’ বা মাদকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, মানুষ যখন ড্রাগ সেবন করে, তখন তার মস্তিষ্কে যে ‘ডোপামিন’ নামক হরমোন নিঃসৃত হয়, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার সময়ও ঠিক একই ধরনের ডোপামিন নিঃসৃত হয়। এই ডোপামিনের মাত্রা বাড়ানোর জন্যই সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে সাইকোলজিস্টদের নিয়োগ করে এমন অ্যালগরিদম তৈরি করেছে, যা মানুষের মনস্তত্ত্বকে ব্যবহার করে তাকে স্ক্রিনে আটকে রাখে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মানুষ প্রতিদিন গড়ে আড়াই ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটায়। ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী টিনেজাররা প্রতিদিন প্রায় ৪.৮ ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকে, যা তাদের সক্রিয় সময়ের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। এই বিপুল সময় যদি কোনো দক্ষতা অর্জনে ব্যয় করা যেত, তবে একজন মানুষ এক বছরে একটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করতে পারত অথবা মার্শাল আর্টসে ব্রাউন বেল্ট স্টেজে পৌঁছে যেতে পারত। কিন্তু এর পরিবর্তে তারা ‘ডুম স্ক্রোলিং’-এর মাধ্যমে নিজেদের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে, যার ফলে তরুণ প্রজন্ম ‘বুদ্ধিবৃত্তিক পক্ষাঘাত’ (Intellectual Paralysis) বা ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্যারালাইসিসে’ ভুগছে।
সাবেক মেটা কর্মচারী এক ভয়ঙ্কর তথ্য ফাঁস করে বলেন, “আমরা আক্ষরিক অর্থেই পকেটে করে ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের জন্য যা যা দরকার, তা সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।” তিনি বলেন, মোবাইল ফোনগুলো ব্যবহারকারীর সকল ডেটা—যেমন কোথায় যাচ্ছেন, কোন ওয়েবসাইটে ব্রাউজ করছেন, কাকে কী মেসেজ করছেন—সবকিছু ট্র্যাক করে। এমনকি, অনেক সময় সাইলেন্টলি অডিও রেকর্ড করে কথোপকথনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়, যা পরবর্তীতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে পাঠানো হয়। টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল, কারণ তারা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে তথ্য শেয়ার করতে রাজি হয়নি।
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যদি কেউ তাদের পছন্দ না হয় এমন কিছু করে, তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের ফোনে থাকা ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। এডওয়ার্ড স্নোডেনের ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, স্নোডেনকে তার কম্পিউটার এবং ফোনের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছিল, যেখানে তার এবং তার স্ত্রীর ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তুলে তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এই ক্ষমতা এখন শুধুমাত্র সরকার বা গোয়েন্দা সংস্থার হাতেই নয়, বরং বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর হাতেও রয়েছে, যারা এটিকে অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-এর উত্থান এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এআই একদিকে যেমন সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, মেডিকেল সার্জারি, ক্যান্সার ডিটেকশন এবং ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের মতো ক্ষেত্রগুলোতে বিপ্লব ঘটাচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে এটি মানুষের চাকরি কেড়ে নিচ্ছে এবং নতুন করে নজরদারির সুযোগ তৈরি করছে। পিনাকী ভট্টাচার্য বলেন, এআই প্রযুক্তিকে যদি সঠিকভাবে ইসলামিক মূল্যবোধের মধ্যে থেকে ব্যবহার করা না হয়, তাহলে মুসলিম উম্মাহ আবারও পিছিয়ে পড়বে। চীন ইতিমধ্যেই তাদের স্কুলের কারিকুলামে প্রাথমিক স্তর থেকেই এআই প্রশিক্ষণ চালু করেছে, যার ফলে বাংলাদেশের শিশুরা যদি দ্রুত এআই শিক্ষা গ্রহণ না করে, তবে তারা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।
তবে, এআই-এর কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। এআই ব্যবহার করে অল্প খরচে কুইজ অ্যাপ্লিকেশন বা জটিল সফটওয়্যার তৈরি করা যাচ্ছে, যা মানুষের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করছে। কিন্তু, এআই-এর মাধ্যমে ডিপফেক ভিডিও তৈরির মতো অপব্যবহারও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ইতিমধ্যেই, অনেক বিখ্যাত ইসলামিক পণ্ডিতদের ডিপফেক ভিডিও ব্যবহার করে পাকিস্তানে যৌন রোগের ঔষধ বিক্রি করা হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
সমাধান কী?
এই ডিজিটাল যুগে নিজেদের এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে:
-
ইন্টারনেট সুরক্ষা: ফিশিং লিংক, ভাইরাস এবং পর্নোগ্রাফি, জুয়া বা ড্রাগস সম্পর্কিত ওয়েবসাইট থেকে দূরে থাকতে হবে। এর জন্য ‘কাভ গার্ড’ বা ‘কাভ ব্রাউজার’-এর মতো অ্যাপ ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
-
স্লিপ অপটিমাইজেশন: রাত ৮-৯টার মধ্যে ঘুমাতে যাওয়া, মোবাইল স্ক্রিনের সাদা আলো এড়িয়ে চলা এবং ক্যাফেইন গ্রহণ কমানো।
-
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন: সাদা চাল, সাদা চিনি এবং সাদা আটা—এই তিনটি ‘হোয়াইট পয়জন’ এড়িয়ে চলতে হবে।
সার্বিকভাবে, স্মার্টফোনের আসক্তি, এআই-এর উত্থান এবং প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি—এই সবকিছু মিলিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের স্বাধীনতা এবং গোপনীয়তা এক নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে শুধুমাত্র ব্যক্তিগতভাবেই নয়, বরং রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক পর্যায় থেকেও একটি সচেতন এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।



















