ড্রুজদের ইতিহাস ও বিশ্বাস
ড্রুজরা একটি স্বতন্ত্র জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, যারা মূলত সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল এবং ইসরায়েল-অধিকৃত গোলান হাইটস-এ বসবাস করে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ লাখ ড্রুজের অর্ধেকই সিরিয়ায় কেন্দ্রীভূত, বিশেষ করে সুওয়াইদা প্রদেশে। তাদের ধর্ম শিয়া ইসলামের একটি শাখা থেকে উদ্ভূত হলেও এটি নিজস্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। ড্রুজরা নিজেদের 'আল-মুওয়াহিদুন' বা 'একত্ববাদী' হিসেবে পরিচয় দেয় এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস গোপনীয়তার ওপর জোর দেয়। তারা পুনর্জন্ম এবং আত্মার স্থানান্তরে বিশ্বাসী। তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি সাধারণ মুসলিমদের থেকে ভিন্ন এবং তারা প্রকাশ্যে তাদের ধর্ম প্রচার করে না।
আসাদ সরকার ও ড্রুজ সম্পর্ক :
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় ড্রুজরা আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছিল। সুওয়াইদা প্রদেশ স্বায়ত্তশাসন ধরে রেখেছিল এবং সেখানে ড্রুজ মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো স্থানীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করত। যদিও আসাদ সরকার তাদের ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করত, কিন্তু ড্রুজরা তাদের ঐতিহ্যবাহী স্বায়ত্তশাসন ধরে রাখতে অনেকটাই সফল হয়েছিল। এই স্বায়ত্তশাসনের কারণে তারা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে কিছুটা দূরে থাকতে পেরেছিল। তবে, এই সম্পর্কের মধ্যেও এক ধরনের চাপা উত্তেজনা সব সময়ই ছিল।
বর্তমান সিরীয় সরকার ও ড্রুজ সংঘাত :
আসাদ সরকারের পতনের পর সিরিয়ায় নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেও, ড্রুজ এবং আরব বেদুইন উপজাতিদের মধ্যেকার পুরনো উত্তেজনা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। ১৩ জুলাই একজন ড্রুজ ব্যবসায়ী অপহরণ হওয়ার পর থেকেই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। ড্রুজ মিলিশিয়া এবং সুন্নি বেদুইন উপজাতিদের মধ্যে এই প্রতিশোধমূলক সহিংসতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং উভয় পক্ষের বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। সিরিয়ার নতুন সরকার এই সংঘাত থামাতে সুওয়াইদা প্রদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করলেও, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো অভিযোগ করছে যে সরকারি বাহিনী বেদুইন উপজাতিদের সাথে মিলে ড্রুজদের ওপর আক্রমণ করেছে। সিরিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আনাস খাত্তাবও এই উত্তেজনার মূল কারণ হিসেবে "রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে সামরিক ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুপস্থিতিকে" দায়ী করেছেন।
ইসরায়েলের সমর্থনের কারণ :
ইসরায়েলের সামরিক হস্তক্ষেপ এই সংঘাতকে আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। ইসরায়েল দাবি করেছে যে তারা সিরিয়ার ড্রুজ সম্প্রদায়ের সুরক্ষার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ করছে। ইসরায়েলে প্রায় ১.৫ লাখ ড্রুজ বসবাস করে এবং তাদের অনেকেই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে কর্মরত। নিজেদের দেশের ড্রুজদের সাথে সম্পর্কের কারণেই ইসরায়েল সিরিয়ার ড্রুজদের প্রতি সংবেদনশীলতা দেখাচ্ছে।
তবে, বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসরায়েলের হস্তক্ষেপের পেছনে আরও গভীর ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। কিছু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক বলেছেন যে, ইসরায়েল সিরিয়ার দক্ষিণ সীমান্তকে একটি "নিরস্ত্রকরণ এলাকা" বানাতে চায়, যাতে সেখানে ইসলামপন্থী যোদ্ধারা শক্তিশালী হতে না পারে। তারা আরও মনে করেন যে, ইসরায়েল সিরিয়ার সামরিক সক্ষমতার অবশিষ্ট অংশ নির্মূল করতে চাইছে এবং সিরিয়াকে স্থায়ীভাবে দুর্বল ও বিভক্ত করতে চাইছে। ১৫ জুলাই থেকে সিরিয়ার সামরিক অবস্থানে ইসরায়েল বিমান হামলা শুরু করে, যা পরবর্তীতে দামেস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সেনা সদর দপ্তরেও আঘাত হানে।
সাধারণ মুসলিম সুন্নিদের সাথে পার্থক্য :
ড্রুজদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রীতিনীতি সাধারণ সুন্নি মুসলিমদের থেকে অনেকটাই ভিন্ন। প্রধান পার্থক্যগুলো হলো:
* গোপনীয় ধর্ম: ড্রুজ ধর্ম কঠোরভাবে গোপনীয় এবং তারা প্রকাশ্যে তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করে না বা ধর্মান্তরকরণে বিশ্বাসী নয়। অন্যদিকে, সুন্নি ইসলাম উন্মুক্ত এবং প্রকাশ্যে পালন করা হয়।
* পবিত্র গ্রন্থ: ড্রুজদের নিজস্ব পবিত্র গ্রন্থ 'রাসাইল আল-হিকমাহ' রয়েছে, যা কোরআনের ব্যাখ্যা হিসেবে দেখা হয়, তবে এটি কোরআন থেকে ভিন্ন। সুন্নি মুসলিমরা কোরআনকে আল্লাহর চূড়ান্ত বাণী হিসেবে বিশ্বাস করে।
* ধর্মীয় স্তম্ভ: ড্রুজদের নিজস্ব ধর্মীয় স্তম্ভ রয়েছে, যা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভ (শাহাদা, সালাত, যাকাত, সাওম, হজ) থেকে ভিন্ন।
* পুনর্জন্ম: ড্রুজরা পুনর্জন্ম বা আত্মার স্থানান্তরে বিশ্বাস করে, যা সুন্নি ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের অংশ নয়।
* সমাজ ও সংস্কৃতি: ড্রুজদের নিজস্ব সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক রীতি রয়েছে, যা তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ :
সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ৩০০ জনের বেশি মানুষ নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছেন। সিরিয়ার সেনাবাহিনী সুওয়াইদা থেকে আংশিক সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও, গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অবস্থানে তাদের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকবে। ড্রুজ সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই সংঘাতে বিভক্তি দেখা দিয়েছে, যেখানে কিছু ড্রুজ নেতা সিরিয়ার সরকারের সাথে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলেও অন্যরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই পরিস্থিতি সিরিয়ার নতুন সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও বেশ কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, যা দেশের স্থিতিশীলতা
বজায় রাখাকে কঠিন করে তুলছে।