শরিফুল খান প্লাবন
সাংবাদিক ও কলাম লেখক
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে তুলছে দেশের ৬৫ হাজারের বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়গুলোতে কোটি-কোটি শিশুর ভবিষ্যৎ নির্মিত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব বিদ্যালয়ের বড় অংশ এখন মারাত্মক শিক্ষক সংকটে ভুগছে। একদিকে শিক্ষকের ঘাটতি, অন্যদিকে কাঙ্ক্ষিত মানের শিক্ষকের অভাব—দুই মিলে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়েছে।
প্রেক্ষাপট: বিপুল সংখ্যক শূন্যপদ
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের শুরুর দিকে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক পদ শূন্য ছিল। এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে অবসর, পদোন্নতি, বদলি ও মৃত্যুর কারণে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চল, চরাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় শিক্ষকসংকট আরও প্রকট।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহীর মতো বিভাগের জেলা সদরগুলোতে কিছুটা শিক্ষক উপস্থিত থাকলেও, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, মাদারীপুর, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ও পটুয়াখালী—এমন অনেক জেলায় দুই থেকে তিনজন শিক্ষক দিয়ে চলছে পুরো একটি বিদ্যালয়।
শিশুদের ভবিষ্যৎ হুমকিতে
জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী, একজন শিক্ষকের ওপর সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থী থাকা উচিত। বাস্তবে দেখা যায়, কোনো কোনো বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক ৮০-১০০ জন শিক্ষার্থীর ক্লাস পরিচালনা করছেন। এতে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া তো দূরের কথা, শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখাও অসম্ভব হয়ে উঠছে।
বিশেষ করে বাংলা, গণিত, ইংরেজি—এই মূল বিষয়ের শিক্ষক সংকট তীব্র। শিক্ষার্থীদের মৌলিক শিক্ষা অর্জনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে এটি।
নিয়োগ প্রক্রিয়া ও প্রশাসনিক জটিলতা
২০২৩ সালের ৪৫তম বিসিএস পরীক্ষায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য বড় পরিসরে শিক্ষক নিয়োগের ঘোষণা এলেও দীর্ঘ সময়েও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তদুপরি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের ফল প্রকাশ ও নিয়োগ প্রক্রিয়া বারবার বিলম্বিত হচ্ছে।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো, অনেক শিক্ষকের ক্লাসে না থাকা বা নিয়মিত না পড়ানো। এটি একটি খোলা গোপন সত্য। কোনো কোনো এলাকায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা শিক্ষকদের উপস্থিতির বিষয়ে তদবির করে থাকেন, যার ফলে দায়বদ্ধতার অভাব দেখা যায়।
প্রধান শিক্ষক সংকট আরও গভীর
শুধু সহকারী শিক্ষক নয়, প্রায় ৭ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন কোনো প্রধান শিক্ষক নেই। ফলে প্রশাসনিক দায়িত্ব, পাঠদানের তদারকি, ছাত্র-ছাত্রীদের শৃঙ্খলা—সব কিছুই ব্যাহত হচ্ছে।
প্রধান শিক্ষক না থাকায় বিদ্যালয় পরিচালনায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। অনেক সময় সহকারী শিক্ষকরা প্রশাসনিক কাজ করতে গিয়ে পাঠদানে সময় দিতে পারছেন না।
কী করণীয়?
১. দ্রুত শূন্যপদ পূরণ: দীর্ঘসূত্রতা বাদ দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করতে হবে।
২. দায়বদ্ধতা নিশ্চিত: বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষক উপস্থিতি ও ক্লাসে পাঠদানের প্রতি কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।
৩. স্থানীয় নিয়োগ: প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য সেখানকার স্থানীয়দের নিয়োগে অগ্রাধিকার দিলে শিক্ষক ধরে রাখা সহজ হবে।
৪. প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন: নতুন ও বিদ্যমান শিক্ষকদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
৫. প্রণোদনা ব্যবস্থা: দুর্গম অঞ্চলে কর্মরত শিক্ষকদের জন্য বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে।
শেষ কথা
একটি জাতির ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তির ওপর। সেখানে যদি শিক্ষকের সংকট দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। তাই এখনই সময়, এই সংকট নিরসনে দ্রুত, কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার।