দীর্ঘদিন কিডনি জটিলতার সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেল ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ ইউনিয়নের হারুয়া গ্রামের বাসিন্দা ও ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সদস্য আফজাল হোসেন হিমেল–এর একমাত্র কন্যা হুমায়রা আক্তার মৌমিতা।
রোববার সকাল ৮টার দিকে রাজধানীর কিউর স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে। তার মৃত্যুতে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীর মধ্যে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া।
মাত্র কয়েক বছরের কোমল জীবনে অগণিত যন্ত্রণা সয়ে গেছে মৌমিতা। কিডনি জটিলতায় তার শরীর মাঝে মাঝেই ফুলে যেত, দিনরাত যন্ত্রণায় কাতর হয়ে থাকত সে। বাবার চোখের সামনে প্রিয় মেয়ের এই কষ্ট সহ্য করা ছিল এক অসম্ভব যন্ত্রণা। তবে সবচেয়ে নির্মম ছিল, বাবা হিমেল রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতার আতঙ্কে মেয়ের চিকিৎসার সময়ও ঠিক মত পাশে থাকতে পারেননি। চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে নিজের সর্বস্ব বিক্রি করেছেন, মানুষের সহযোগিতা চেয়েছেন। কিন্তু শেষ বিদায়ে প্রিয় সন্তানকে বিদায় জানাতে পারেননি।
হিমেলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কারণে দায়ের হওয়া একাধিক মামলায় গ্রেফতার পরোয়ানা থাকায় দীর্ঘদিন ধরেই তিনি পলাতক জীবনযাপন করছিলেন।
রাজনীতি ও আইনের জটিলতার বেড়াজালে বন্দী এক অসহায় বাবা কেবল দূর থেকে দেখেছেন মেয়ের জীবন নিভে যাওয়ার দৃশ্য। তার বুকভাঙা কান্না ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুক পোস্টে—
হিমেল তার পোস্টে লিখেছেন “বাদ মাগরিব, হারুয়া হারুননগর জামে মসজিদে আমার মেয়ে মৌমিতার জানাজা অনুষ্ঠিত হইবে। আমি জানাজায় অংশগ্রহণ করতে পারব না। আমি আপনাদের হাতে ও মহান আল্লাহতালার হাতে আমার মেয়েকে দিয়ে দিলাম।”
এই একটি পোস্টে যেন মিশে আছে হাজারো বাবার নীরব আর্তনাদ। পোস্টটি মুহূর্তেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
কান্নাভেজা কণ্ঠে হিমেল বলেন, মৌমিতার শরীর কিছুদিন পরপর ফুলে যেতো। অনেক চিকিৎসা করিয়েছি, কিছুটা ভালো হতো, আবার খারাপ হয়ে যেত। মেয়েটাকে বাঁচাতে আমার সব দিয়েছি। এমনকি মানুষের কাছ থেকেও সাহায্য নিয়েছি। কিন্তু শেষ সময়ে তার পাশে থাকতে পারলাম না— এই কষ্ট আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না।
পরিবারের সদস্যদের বরাতে জানা গেছে, বাদ মাগরিব মাইজবাগ ইউনিয়নের হারুয়া হারুননগর জামে মসজিদে মৌমিতার জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তবে সেই বিদায়ের মুহূর্তে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি— পিতা হিমেল— থাকবেন না সেখানে।
মাইজবাগের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হিমেল ছিলেন একজন সাহসী, সামাজিক ও পরিশ্রমী যুবক। রাজনীতির কারণে তিনি নানা হয়রানির শিকার হন। মেয়ের অসুস্থতার সময়েও পুলিশের ভয়ে তিনি প্রকাশ্যে আসতে পারেননি।
এমন এক বাবার গল্প আজ এলাকায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু— সবাই বলছে,
“রাজনীতি যা-ই হোক, একজন বাবার কষ্টের কোনো রং হয় না।”
যে মেয়ে একদিন বাবার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতো, আজ সে শায়িত শীতল মাটির বুকে।
কিন্তু সেই কবরের পাশে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলতেও পারছেন না তার বাবা।
দূর কোথাও, নিঃসঙ্গ হিমেল হয়তো এখনো কাঁদছেন—
“আমার মেয়েকে আমি আল্লাহর হাতে সঁপে দিলাম…”
একটি মেয়ের বিদায়, এক বাবার অসহায় নীরবতা, আর এক সমাজের নীরব কান্না।