close

ভিডিও দেখুন, পয়েন্ট জিতুন!

প্রতিবন্ধী নয়, সক্ষম নাগরিক: একটি সমাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি..

SHARIFUL KHAN PLABAN avatar   
SHARIFUL KHAN PLABAN
****

বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধীদের এখনো "বিপর্যস্ত" বা "দয়া প্রাপ্য" মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যদিও তারা মানবসম্পদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারেন যদি সঠিক সুযোগ ও সহায়তা পান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার অন্তত ৯ শতাংশ কোনো না কোনো রকম প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বেঁচে আছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) হিসেবে এই সংখ্যা আরও বেশি—প্রায় ১৫ শতাংশ।

প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কথা বলার সময় আমাদের সমাজে সাধারণত করুণা, দয়া ও সহানুভূতির ভাষা ব্যবহার করা হয়, অথচ দরকার অধিকার ও সমতা ভিত্তিক আলোচনার। একটি সভ্য ও মানবিক রাষ্ট্র কেবল তার মেধাবীদের দিয়েই গড়ে ওঠে না; যারা পিছিয়ে আছে, তাদেরও তুলে ধরার মধ্যেই প্রকৃত উন্নয়ন নিহিত।

বর্তমান বাস্তবতা

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের অধিকাংশই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। যদিও ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’ অনুসারে সকল প্রতিবন্ধীর জন্য শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, বাস্তবতা হলো, সরকারি স্কুলে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো ও পাঠ্যবই এখনো প্রতিবন্ধীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। শ্রবণ বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল ও সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের সুযোগ সীমিত। ফলে, অনেকেই প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডিও পেরোতে পারেন না।

শুধু শিক্ষাই নয়, কর্মসংস্থানেও প্রতিবন্ধীরা ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার। সরকারি নিয়োগে কোটার ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবে এটি কার্যকর হয় না। বেসরকারি পর্যায়ে তো সেই সুযোগ আরও দুর্লভ। ফলে অধিকাংশ প্রতিবন্ধী পেশাগত জীবনে প্রবেশ করতে না পারায় পরিবার ও সমাজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। যা শেষ পর্যন্ত তাদের আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদাবোধে আঘাত হানে।

সামাজিক মনোভাব: সবচেয়ে বড় বাধা

প্রতিবন্ধীদের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা তাদের শারীরিক সীমাবদ্ধতা নয়, বরং সমাজের নেতিবাচক মনোভাব। অনেক অভিভাবক এখনো প্রতিবন্ধী সন্তানকে গোপন রাখতে চান। সমাজের বিভিন্ন স্তরে বৈষম্যমূলক শব্দ, উপহাস, কিংবা করুণার দৃষ্টিতে তাকানো তাদের মনোবলে আঘাত করে। অথচ একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, সে প্রতিবন্ধী হোক বা না হোক, সে সমাজেরই অংশ। তার সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করা মানেই সমাজের একটি সম্ভাবনাকে খর্ব করা।

কিছু ইতিবাচক দিক

সামপ্রতিক সময়ে কিছু বেসরকারি সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রশংসনীয় কিছু কাজ হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ‘সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অফ দ্য প্যারালাইজড’ (CRP), ‘বাংলাদেশি ডিজঅ্যাবলড ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট’ (BDDT), ‘ইন্সপায়ার’ বা ‘প্রত্যাশা’—এই রকম অনেক সংগঠন প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে কাজ করছে।

এছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। জাতিসংঘের ‘কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব পারসন্স উইথ ডিজএবিলিটিজ (CRPD)’-এ বাংলাদেশ ২০০৭ সালে স্বাক্ষর করেছে, এবং এর অধীনে বিভিন্ন আইন ও নীতিমালাও তৈরি হয়েছে।

প্রযুক্তি: প্রতিবন্ধীদের জন্য নতুন সম্ভাবনা

বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি প্রতিবন্ধীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য টকিং সফটওয়্যার, হেয়ারিং ইমপেয়ারডদের জন্য ভিডিও কল সিস্টেমে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ অপশন, কিংবা চলাফেরার সমস্যা থাকা ব্যক্তিদের জন্য মোবাইল অ্যাপ ও স্মার্ট হুইলচেয়ার—এসব উদ্ভাবন প্রতিবন্ধীদের আত্মনির্ভরশীল জীবনযাপনকে সহজতর করছে।

সরকার যদি এসব প্রযুক্তি সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করতে পারে, তবে প্রতিবন্ধীরা সমাজে অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি অবদান রাখতে পারবেন। বিশেষ করে ঘরে বসে কাজ করার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে—তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতিবন্ধীদের জন্য হোম-বেইজড কাজ বা ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ চালু করা যেতে পারে।

করণীয় ও সুপারিশ

১. নির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ: প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে এবং তা কীভাবে ব্যয় হচ্ছে, তার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে।

২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা: প্রতিটি স্কুলে প্রতিবন্ধীবান্ধব অবকাঠামো, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, ও বিশেষ সহায়ক উপকরণ থাকা আবশ্যক।

৩. কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ: সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা নিশ্চিত করা ও বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

৪. সামাজিক সচেতনতা: গণমাধ্যম ও শিক্ষা পাঠ্যক্রমে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে ইতিবাচক বার্তা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যাতে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়।

৫. স্থানীয় সরকার ও ইউনিয়ন পর্যায়ে তথ্য ভাণ্ডার: কে কোথায় কী ধরণের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আছেন, তাদের জন্য কী সহায়তা দরকার—সেই তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনা জরুরি।

উপসংহার

একটি দেশ উন্নত হয় তখনই, যখন সে তার সকল নাগরিককে সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, বরং যদি তারা সঠিক সহায়তা ও সুযোগ পান, তাহলে তারাই হতে পারেন উদাহরণ। একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই পারে সমাজকে আরও মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলতে।

আমরা সবাই যদি ভেবে নিই, “প্রতিবন্ধী নয়, তারা শুধু ভিন্নভাবে সক্ষম”—তাহলেই বদল আসবে। শুধু রাষ্ট্র নয়, আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই থাকতে হবে সেই পরিবর্তনের চেতনা।

 

শরিফুল খান প্লাবন 

সাংবাদিক ও কলাম লেখক 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

SHARIFUL KHAN PLABAN
শরিফুল খান প্লাবন
0 0 Reply
Show more