সবকিছুর পরও, মেসির নামের পাশে তখনও একটা অপূর্ণতা ঝুলে থাকত। ক্লাব ফুটবলে জিতেছেন সবই, কিন্তু জাতীয় দলের জার্সিতে শুধু হাহাকার। চারটি ফাইনাল খেলেছেন, চারবারই হতাশা। ২০১৬ কোপার ফাইনালের পর চোখের পানি নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক ফুটবল ছাড়ার ঘোষণা দিলেন, আর্জেন্টিনার প্রতিটি গৃহে যেন শোক নেমে এলো। সেদিন কেউ ভাবেনি, এই মানুষটাই একদিন দেশের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন বাস্তব করে ফেলবেন।
তবু তিনি ফিরেছিলেন। আর সেই ফেরাই যেন ছিল এক নীরব প্রতিজ্ঞা—একদিন না একদিন এই দেশের জার্সিতেই নিজের সব কষ্ট ধুয়ে ফেলবেন।
২০২১ সালের কোপা আমেরিকা নিয়ে কারও প্রত্যাশা ছিল না খুব বেশি। ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে ফেভারিট ছিল স্বাগতিকরাই। আর মারাকানার মাটি, আর্জেন্টিনার অতীতের অনেক যন্ত্রণার সাক্ষী। কিন্তু কে জানত, সেই মাটিতেই লেখা হবে আনন্দের এক নতুন অধ্যায়?
ফাইনালের দিন। গ্যালারিতে তেমন দর্শক নেই, কিন্তু গোটা বিশ্ব জানত, এই ম্যাচ শুধু দুই দলের নয়, এক ব্যক্তির মুক্তির ম্যাচ। শুরু থেকেই জমাট লড়াই। ২২ মিনিটে ডি মারিয়ার গোল যখন ব্রাজিলের জালে, তখনও মেসির মুখে কোনো উচ্ছ্বাস ছিল না। চোখেমুখে যেন একটাই কথা—‘শেষ বাঁশি না বাজা পর্যন্ত কিছুই শেষ নয়।’
৯০ মিনিট শেষ। রেফারির বাঁশি বাজতেই যেন বিস্ফোরিত হলো আটকে থাকা শত শত দিনের আবেগ। সতীর্থেরা ছুটে এসে মেসিকে জড়িয়ে ধরেছে, কেউ চিৎকার করছে, কেউ মাটিতে শুয়ে কাঁদছে। আর মেসি? তিনি তখন এক কোণে বসে, হাতে ধরা সেই সোনালি ট্রফি। চোখে জল, ঠোঁটে নিঃশব্দ হাসি।
এই ট্রফি শুধু একটা কাপ ছিল না। এটা ছিল তাঁর দীর্ঘ যাত্রাপথের সম্মাননা। এটা ছিল তাঁদের উত্তর যারা বলত, "ক্লাবের বাইরে তো কিছুই জিততে পারো না!" মেসি তাঁদের কোনো কথায় উত্তর দেননি। উত্তর দিয়েছিলেন মাঠে, মারাকানায়।
সেই টুর্নামেন্টে মেসি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। গোল করেছেন, করিয়েছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রতিটি ম্যাচেই তাঁর চোখে ছিল এক ধরনের স্থির পাগলামি—যা বলে দেয়, এবার কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। সেই আগুনের ফলাফলই ছিল শিরোপা আর অগণিত মানুষের চোখে পানি।
সেই রাত বদলে দেয় অনেক কিছু। শুধু মেসির ভাগ্য নয়, আর্জেন্টিনা ফুটবলের মানচিত্রও যেন নতুন করে আঁকা হয়। এরপর আসে ‘ফিনালিসিমা’, আসে কাতার বিশ্বকাপের চূড়ান্ত মহাকাব্য। কিন্তু এই মহাকাব্যর প্রথম পাতাটা লেখা হয়েছিল সেদিন, মারাকানার সবুজ ঘাসে।
চার বছর পরও মানুষ বলে, “মেসি তো বিশ্বকাপ জিতেছে।” ঠিক। কিন্তু যারা সেদিন রাত জেগে সেই ফাইনাল দেখেছিল, তারা জানে—মেসি আসলে প্রথম জিতেছিলেন কোপা আমেরিকায়, ২০২১ সালের ১০ জুলাই, রিওর আকাশের নিচে।
সেই জয়ের মধ্যে ছিল শান্তি, ছিল চোখের পানি, ছিল বিজয়ের চিৎকার—আর ছিল একটা মানুষের নিজের জাতির সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বলার সাহস:
“এবার আমি পেরেছি।”