close

কমেন্ট করুন পয়েন্ট জিতুন!

কুষ্টিয়ার চার আসন। বিএনপিতে কোন্দল, প্রভাব পড়তে পারে ভোটে..

Imran Hossain avatar   
Imran Hossain
****

 

পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া এক সময়ে বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন ও দুঃশাসনে সব ওলটপালট হয়ে গেছে। দেড় দশক ভোটাধিকারবঞ্চিত ছিল জেলাবাসী।

জুলাই বিপ্লবের পর সেই সুযোগ ফিরে এসেছে। সবাই স্বপ্ন দেখছে উৎসবমুখর পরিবেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার। তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে নানা প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

কুষ্টিয়ার ছয় উপজেলা নিয়ে চারটি সংসদীয় আসন গঠিত। ভোটের মাঠে সব দলের নেতা তৎপর থাকলেও তাদের কাজের ধরন অভিন্ন নয়। এমনকি দলে সবারই নানারকম সংকট ও চ্যালেঞ্জ আছে। এর ওপর নির্ভর করছে তাদের নির্বাচনি ফলাফল। বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করছে অন্তর্কোন্দল। ত্রয়োদশ নির্বাচনের আমেজ তৈরি হওয়ায় ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে সেই সংকট। জেলা বিএনপি নেতারাও এক কার্যালয়ে বসেন না। তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে একাধিক কার্যালয় নিয়ে দলীয় কার্যক্রম সারছেন। মনোনয়ন যিনিই পান না কেন, বিভাজন থেকে বের হওয়া কঠিন হবে। এছাড়া দলটির কিছু নেতাকর্মীর চাঁদাবাজি ও দখলবাণিজ্য ক্রমেই কঠিন পরীক্ষায় ফেলছে ধানের শীষকে।

অন্যদিকে বৃহত্তম ইসলামি দল জামায়াত এমন ঝামেলার ঊর্ধ্বে উঠে ইতোমধ্যে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। শিক্ষিত ও নির্ভেজাল নেতাদের নমিনেশন দেওয়ায় বেশ সাড়াও পাচ্ছেন তারা। প্রার্থীরা নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন, জয় করছেন ভোটারদের হৃদয়। অন্য দলগুলোর নেতাকর্মীরাও মোটামুটি সরব আছেন।

কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর)

ভারত সীমান্ত ঘেঁষা এ উপজেলায় বিএনপি অন্তত তিনটি ধারায় বিভক্ত। উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা একটি ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই ধারার নেতাকর্মীরা বাচ্চু মোল্লার ভাই ও ছেলে শিশির মোল্লার নেতৃত্বে দৌলতপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে চাঁদাবাজিসহ পদ্মার চর এবং সীমান্ত এলাকার নানা অপকর্মে জড়িত।

দ্বিতীয় ধারাটির নেতেৃত্বে আছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুজ্জামান হাবলু মোল্লা। তারা চাঁদাবাজিসহ অবৈধ সিগারেট তৈরিতে জড়িত। ভারতে নিখোঁজ আওয়ামী এমপি আনারের প্রাডো গাড়িটি যে চক্র কুষ্টিয়ায় এনেছিল, সেই চক্রের অন্যতম সদস্য বিএনপির এই নেতা। আরেকটি ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব শহিদুল ইসলাম সরকার মঙ্গল। এ ধারায় উপজেলা বিএনপির সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা আছেন। ফ্যাসিবাদের পতনের পর কিছু বিএনপি নেতাকর্মীর অপকর্মে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। অপকর্ম বন্ধ করতে না পারলে একসময়ের বিএনপির ঘাঁটি জামায়াতের দুর্গে পরিণত হতে পারে। তবে জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোর মধ্যে কোনো কোন্দল নেই।

এ আসনে ধানের শীষ পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা বিএনপি সভাপতি রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের আহ্বায়ক শরিফ উদ্দিন জুয়েল, উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব শহীদ সরকার মঙ্গল, উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুজ্জামান হাবলু মোল্লা ও ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসসের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসনাইন নাহিয়ান সজীব। তারা ছাড়াও বেশ কয়েকজন বিএনপি হাইকমান্ডে তদবির চালাচ্ছেন।

শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিএনপির দীর্ঘদিনের কর্মী হিসেবে দলের মনোনয়ন চাইব। তবে মনোনয়ন যিনিই পান, তার পক্ষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব।’

জামায়াত মনোনয়ন দিয়েছে উপজেলা শাখার উপাধ্যক্ষ মাওলানা বেলাল উদ্দিনকে। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন উপজেলা শাখার সভাপতি মুফতি অমিনুল ইসলামকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। খেলাফত মজলিসের মনোনীত প্রার্থীর নাম মাওলানা শরীফুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মাওলানা আসাদুজ্জামান। এনসিপির কেন্দ্রীয় নেত্রী নুসরাত তাবাচ্ছুম নির্বাচন করবেন বলে শোনা যাচ্ছে।

কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর ও ভেড়ামারা)

বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায় থেকে উপজেলা পর্যন্ত অঙ্গসংগঠনগুলোর কমিটিতে সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম অনুসারীদের প্রাধান্য আছে। যদিও এবার তিনি মনোনয়নপ্রত্যাশী নন। বিগত দিনে হাইকোর্টে নেতাকর্মীদের মামলায় সাহায্য করায় উল্লেখযোগ্য সমর্থন আছে দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরীর। এছাড়া ঢাকা জেলা (অবিভক্ত) মহিলা দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিনের কিছু সমর্থক আছে।

বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরী, কেন্দ্রীয় মহিলা দলের নেত্রী ফরিদা ইয়াসমিন ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট তৌহিদুল ইসলাম আলম মালিথা। এর বাইরে বিএনপির দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মহাসচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য আহসান হাবীব লিংকন মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি ২০১৮ সালেও ধানের শীষ প্রতীকে এই আসনে নির্বাচন করেন। এবারও তার সমর্থকরা সামাজিকমাধ্যমে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট চাচ্ছেন।

জামায়াত জেলা শাখার নায়েবে আমির ও মিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল গফুরকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রার্থী হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ আরিফুজ্জামান আরিফ, খেলাফত মজলিসের প্রার্থী জেলা সভাপতি মুফতি আবদুল হামিদ এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ আলী।

কুষ্টিয়া-৩ (সদর)

বিএনপির তৃণমূলের অধিকাংশ নেতাকর্মী দলটির কেন্দ্রীয় সমবায়বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিনের সমর্থক ছিলেন। বর্তমান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব ইঞ্জিনিয়ার জাকির হোসেন সরকার নতুন কমিটিতে তার অনুসারীদের স্থান দিচ্ছেন। কমিটিতে স্থানপ্রাপ্তরা চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম করছেন। এ আসনে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে অশান্ত হয়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে শক্তি বাড়াচ্ছে দুই পক্ষই। এতে আওয়ামী লীগ কর্মীদেরও ব্যবহার করছেন তারা। যার প্রভাব পড়তে পারে আগামী নির্বাচনে। তরুণ ভোটার ও বিএনপির সমর্থকরা জামায়াতের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন। ফলে এ আসনে জয় পেতে বিএনপির জন্য কষ্টকর হবে। তবে দলের অধিকাংশ সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা আছেন প্রকৌশলী জাকির হোসেন সরকারের সঙ্গে। আর তৃণমূলে প্রভাব সোহরাব উদ্দিনের হাতে।

বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন- অধ্যক্ষ সোহরাব, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কুতুব উদ্দিন আহমেদ, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ইঞ্জিনিয়ার জাকির ও কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি অ্যাডভোকেট শামিম উল হাসান অপু।

কুতুব উদ্দিন বলেন, ‘আমি বিএনপির দীর্ঘদিনের কর্মী হিসেবে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। আশা করি আগামী নির্বাচনে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে (নেতাকর্মীরা) দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করে কুষ্টিয়ার সংসদীয় আসনগুলো খালেদা জিয়াকে উপহার দিতে পারব।’

জামায়াত প্রখ্যাত ইসলামি বক্তা মুফতি আমির হামজাকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মাওলানা আবদুল লতিফ খান, ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা আহম্মদ আলী এবং খেলাফত মজলিসের প্রার্থী অধ্যাপক সিরাজুল হক।

কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী ও খোকসা)

বিএনপির দুই প্রবীণ নেতা দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী এবং জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও কুমারখালী পৌরসভার চারবারের সাবেক মেয়র নুরুল ইসলাম আনছার প্রামাণিকের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এর আগে এ আসনে দলটির রাজনীতি এ দুই নেতার হাতে ছিল। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর অরেকটি ধারা তৈরি হয়েছে। ক্ষুদ্র এই ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপির হাইকমান্ডের কাছের লোক পরিচয় দেওয়া শেখ সাদী। এর বাইরে গত দুই-তিন মাসে আরেকটি ধারা তৈরি হয়েছে কৃষক দল কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য হাফেজ মো. মঈনউদ্দিনের নেতৃত্বে।

বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন- সৈয়দ মেহেদী, নুরুল ইসলাম, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ সাদী ও হাফেজ মঈনউদ্দিন।

হাফেজ মঈনউদ্দিন বলেন, ‘আগামীর বাংলাদেশে নেতৃত্ব দেবেন তরুণরা। তাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাতকে শক্তিশালী করতে এ আসনে নির্বাচন করতে চাই।’

জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে কুমারখালী উপজেলা শাখার নায়েবে আমির ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আফজাল হোসাইনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রার্থী ফজলে নূর ডিকো, খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মাওলানা আলী আশরাফ এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী আনোয়ার খান।

দৈনিক আমার দেশ।

No comments found