সত্যজিৎ দাস:
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার মনু নদীর কটারকোনা বাজারসংলগ্ন বালুমহাল থেকে উত্তোলিত প্রায় ২৭ কোটি টাকার বালু নিয়ে চলছে সংঘবদ্ধ লুটপাট। প্রায় দুই বছর আগে ইজারার মেয়াদ শেষ হলেও সাবেক ইজারাদার দীপক দে ও বর্তমান ইজারাদার নাজমুন নাহার লিপির যোগসাজশে প্রশাসনিক অনুমতি ছাড়াই প্রতিদিন বিক্রি করে নেওয়া হচ্ছে সরকারি এই সম্পদ।
১৪৩০ বাংলা সনে বালুমহালের ইজারা পেয়েছিলেন পৃথিমপাশা ইউনিয়নের দীপক দে। ইজারার মেয়াদ শেষ হলেও তিনি ইজারাকালীন সময়ে নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে রেখে যাওয়া বালু বিক্রি করে চলেছেন।
বর্তমানে ইজারা রয়েছে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সেলিম আহমদের স্ত্রী নাজমুন নাহার লিপির নামে। অভিযোগ রয়েছে,তিনিও সাবেক ইজারাদারের সঙ্গে মিলে বালু ব্যবসায় অংশীদারত্ব তৈরি করে ওই জমাট বালু অবৈধভাবে বিক্রি করছেন।
স্থানীয়দের দাবি;যেহেতু ইজারা শেষ,জমাট বালুর মালিকানা এখন সরকারের,তাই বিক্রি করা বেআইনি। বরং এসব বালু নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর দাবি জানায় এলাকাবাসী।
বর্তমান ইজারাদার নাজমুন নাহার লিপি বালুমহাল পরিচালনার জন্য কুলাউড়ার ব্যবসায়ী আব্দুল হাছিবকে আমমোক্তার নিয়োগ দেন। পরে অংশীদারত্ব সংক্রান্ত বিরোধ এবং ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে আব্দুল হাছিব কুলাউড়া সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে স্বত্ব ১৭৯/২০২৫ মামলা দায়ের করেন।
আদালত দীপক দে,জামিল ইকবাল ও আব্দুল মুকিত গংয়ের বিরুদ্ধে অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেন এবং মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আব্দুল হাছিবকে বালুমহাল পরিচালনায় বাধা না দেওয়ার নির্দেশ দেন।
কিন্তু আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও,অভিযোগ রয়েছে দীপক দে ও তাঁর লোকজন ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে আদালতের আদেশ সংবলিত সাইনবোর্ড উপড়ে ফেলেন।
সরকারি এই বালু লোপাটের অভিযোগে শেষপর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন হস্তক্ষেপ করে। হাজীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপ-সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মতিউর রহমান জানান,“পূর্বে উত্তোলিত বালুর পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট,যার বাজারমূল্য প্রায় ২৭ কোটি টাকা। সাবেক ও বর্তমান ইজারাদার মিলে অনুমতি ছাড়া বালু বিক্রি করছিলেন। এসিল্যান্ড স্যারের উপস্থিতিতে অভিযান চালিয়ে বালু জব্দ করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন,“জব্দকৃত বালু বর্তমানে প্রশাসনের জিম্মায় রয়েছে এবং জমাট বালুর স্তুপগুলোতে লাল পতাকা টানিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন এসিল্যান্ড বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে।”
বালু পাচারের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ৩৫-৪০ টন ওজনের ১০ চাকার ওভারলোড ডাম্পার ট্রাক। এই যানবাহন নিয়মবহির্ভূতভাবে হাজীপুর,পৃথিমপাশা ও টিলাগাঁও ইউনিয়নের স্থানীয় সড়ক ও নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ দিয়ে চলাচল করছে।
ফলে সড়কে ফাটল,ধস ও গর্ত সৃষ্টি হচ্ছে এবং মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। সালন, হরিচক,কনিমোড়া ও সাধনপুর এলাকায় স্থানীয়রা দুর্ভোগে পড়েছেন।
গত সোমবার কুণিমোরা এলাকায় এলাকাবাসী বালুবাহী ট্রাক আটকে প্রতিবাদ করলে ইজারাদারের লোকজন উল্টো স্থানীয়দের ওপর চড়াও হন বলে অভিযোগ।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহ জহরুল হোসেন বলেন,“ইজারার মেয়াদ শেষে কেউ বালু নিতে পারে না। আমরা জব্দ করেছি এবং পরবর্তীতে কেউ আইন লঙ্ঘন করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোছাঃ শাহীনা আক্তার বলেন, “বিষয়টি খতিয়ে দেখে দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সাবেক ইজারাদার দীপক দে দাবি করেন, “জটিলতার কারণে সময়মতো বালু সরাতে পারিনি। এখন বর্তমান ইজারাদারের সঙ্গে অংশীদার হয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে বালু সরবরাহ করছি।”
বর্তমান ইজারাদার নাজমুন নাহার লিপি ও তাঁর স্বামী সেলিম আহমদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।
মনু নদীর বালুমহাল থেকে সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পায়। অথচ এখন রাজস্ব ফাঁকি,আদালতের আদেশ অমান্য,সড়ক ধ্বংস,নদীভাঙন সবকিছু মিলে চলছে অবাধ দুর্নীতির মহোৎসব।
স্থানীয়রা বলছেন;প্রশাসনের সামনেই যদি এত কিছু হয়, তাহলে রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষা করবে কে?