ইতিহাস বিকৃতির মুখোশ উন্মোচন

Sampadakiya Anuchchhed avatar   
Sampadakiya Anuchchhed
জনপরিসরে কথা বলার একটি নৈতিক শৃঙ্খলা আছে। ব্যক্তিগত পরিচয়, পদ, অতীত পেশা এসব দিয়ে যুক্তিকে খাটো করা নয়, তথ্য ও তর্ক দিয়েই কথা টিকিয়ে রাখা শালীনতা। মতের বিরোধ থাকবে, কিন্তু ভাষা হতে হবে সংযত; ভিন্..

সালাউদ্দিন আহমেদ ঘোষণা দিলেন জুলাই সনদের কোনো আইনি ভিত্তি নেই, কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নেই। প্রশ্ন করি, আপনি কে? কী যোগ্যতা নিয়ে ইতিহাসের এই অমূল্য দলিলকে 'আবেগজনিত' বলে খাটো করছেন? একটি জাতির দীর্ঘ সংগ্রামের স্মারককে আবেগের নামে বাতিল করার সাহস কোথা থেকে পেলেন? আপনার কণ্ঠস্বরের ভেতরে কার ইঙ্গিত, কার প্ররোচনা কাজ করছে?

মানুষ আপনাকে চেনে। আপনার অতীত ঢাকা পড়ে নেই। আপনি একসময় একটি প্রতিষ্ঠানের সামান্য কেরানি ছিলেন। সেখান থেকে 'ঠেলে গুঁতে' সামান্য উপরে উঠলেন, তারপর শিক্ষকের আসনে জায়গা করে নিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শিক্ষক হওয়া মানেই কি ইতিহাসবিদ হওয়া? কেরানি থেকে শিক্ষক হওয়া লজ্জার নয়, কিন্তু শিক্ষক থেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাজা এটা কি আপনার সাধ্য? ইতিহাস নিয়ে কথা বলার জন্য যে প্রজ্ঞা, যে গবেষণা, যে দলিলপত্রের শক্তি লাগে, তা কি আপনার হাতে আছে? না কি কেবল বক্তৃতার ঝড় তুলে ইতিহাস বাতিল করার নতুন খেলায় মেতেছেন?

আপনি বললেন, জুলাই সনদের কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নেই। তাহলে প্রশ্ন করি, রাজনৈতিক ভিত্তি বলতে কী বোঝেন আপনি? একটি জাতির দীর্ঘ আন্দোলন, অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ, নেতাদের রক্ত-ঘামে লেখা চুক্তি এসব কি রাজনৈতিক ভিত্তি নয়? যদি জুলাই সনদ রাজনৈতিক ভিত্তি না হয়, তাহলে আপনার মতে কোন দলিল হবে রাজনৈতিক ভিত্তি? ইতিহাসের পাতায় যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যে সনদে গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে, সেটিকেই আপনি অস্বীকার করেন কোন যুক্তিতে?

আরেকটি প্রশ্ন যদি জুলাই সনদ না থাকত, আপনি আজ কোথায় দাঁড়িয়ে থাকতেন? যে আন্দোলন আপনাকে এবং আপনার মতো অসংখ্য মানুষকে রাজনৈতিক পরিচয় দিয়েছে, যে আন্দোলনের ফলেই পরিবর্তনের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল সেই ইতিহাসকেই আপনি এখন মুছে দিতে চান? আগস্টের বিপ্লব না হলে, জুলাই সনদের চুক্তি না হলে, আপনি আজ কোন জায়গায় থাকতেন? আপনি তো সেখানেই পড়ে থাকতেন, যেখানে আপনার অবস্থান ছিল একজন সাধারণ কর্মচারী, একটি কর্পোরেট অফিসের সামান্য কেরানি।

তাহলে হঠাৎ আজ আপনি কার দৌলতে ইতিহাসের শিক্ষক হয়ে উঠলেন? সেই ইতিহাসকে নিয়েই আজ কটাক্ষ করছেন! এ যেন অকৃতজ্ঞতার চূড়ান্ত রূপ। যার কাঁধে ভর করে দাঁড়ালেন, তাকেই অস্বীকার করছেন। এর চেয়ে বড় আত্মপ্রবঞ্চনা আর কী হতে পারে?

আপনি যে যুক্তি দাঁড় করান, তা হাস্যকর এবং অসাড়। আপনি কি জানেন না ইতিহাসের দলিল কেবল আদালতের আইনে টিকে থাকে না, ইতিহাস টিকে থাকে মানুষের হৃদয়ে, সংগ্রামে, আত্মত্যাগে। একটি আন্দোলনের শক্তি কোনো সংবিধানের ধারা নয়, কোনো আদালতের রায় নয় বরং লাখো মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রাম। আপনি যদি এটাকে অস্বীকার করেন, তাহলে আপনি জনগণের রক্ত-ঘামে লেখা সেই দলিলকেই অপমান করছেন।

তাহলে প্রশ্ন করি আপনি আসলে কার স্বার্থে কাজ করছেন? আপনার কণ্ঠে যে সুর বাজছে, তা কার তন্ত্রী থেকে টানা হচ্ছে? জনগণের স্বার্থে নয়, জাতির স্বার্থেও নয়। তাহলে কাদের স্বার্থে আপনি ইতিহাসকে বিকৃত করছেন? জনগণ কি তা জানে না?

আপনার অতীত আরও প্রশ্ন তোলে। দীর্ঘ বছর আপনি কাদের ছায়ায় রাজনীতি করেছেন, কাদের নির্দেশে চলেছেন সবাই জানে। আপনি বিদেশি স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, আর আজ ইতিহাসের শিক্ষক হয়ে আমাদের জাতির দলিল নিয়ে থিসিস লিখছেন! আপনাকে প্রশ্ন করি এটাই কি আপনার নৈতিকতা? একজন এজেন্টের মতো দীর্ঘ সময় যারা আপনাকে লালন করেছে, তাদের প্রভাবেই কি আজ আপনি জুলাই সনদকে অস্বীকার করার সাহস পাননি?

এখানে আরেকটি প্রশ্ন উঠে আসে। ইলিয়াস আলী ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাই তিনি আজ নেই। কিন্তু আপনি ভারতের পক্ষে থেকে জামাই-আদর পেয়েছেন, সেই কারণে আজ নিরাপদে। আপনি কি অস্বীকার করবেন না যে আপনার অবস্থান তৈরি হয়েছে বাইরের শক্তির প্রশ্রয়ে? এই প্রশ্রয় ছাড়া আপনি কি আজ এত বড় করে কথা বলতে পারতেন?

জাতি জানে, আপনি এস আলম গ্রুপের একজন কর্মচারী ছিলেন। সেই জায়গা থেকে শুরু করে নানা মোড় ঘুরে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে কি আপনি জাতির ইতিহাসের বিচারক? আপনি কি নিজেকে জনগণের ওপরে বসাতে চান?

ইতিহাস কখনো মুছে যায় না। ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টায় কেবল বক্তা নিজেকে মুছে দেয়। আপনি যে বক্তব্য রেখেছেন, তা ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টারই অংশ। আপনার এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে আপনি জনগণের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন।

তাহলে বলছি, হুশ করে কথা বলুন। ইতিহাসের সত্যকে খাটো করার চেষ্টা করবেন না। যে যোগ্যতা আপনার নেই, তা নিয়ে আলোচনার সাহস দেখাবেন না। জুলাই সনদের রাজনৈতিক ভিত্তি নেই বলার আগে নিজের রাজনৈতিক ভিত্তি একবার যাচাই করুন। আপনার নিজের জন্মের ভিত্তিই যদি অন্যের দয়ার ওপরে হয়, তবে অন্যের ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন তোলা আপনার সাজে না।

 উক্তি

ইতিহাসকে অবজ্ঞা করা মানে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। যে জুলাই সনদের আলোতে একটি জাতির সংগ্রাম উজ্জ্বল হয়েছিল, যে বিপ্লবের ঢেউতে মানুষের রক্ত-ঘামে জন্ম নিয়েছিল নতুন স্বপ্ন সেই সনদকে 'ভিত্তিহীন' বলা শুধু যুক্তির দারিদ্র্যতা নয়, নৈতিকতারও চরম পতন। যে ব্যক্তি নিজের অতীত ভুলে ইতিহাসের বিচারক হতে চায়, সে কেবল নিজের মুখোশটাই উন্মোচন করে। ইতিহাস কখনো আদালতের কাগজে সীমাবদ্ধ নয়, ইতিহাস টিকে থাকে মানুষের বিশ্বাসে, মানুষের আত্মত্যাগে। আর যিনি ইতিহাসকে অস্বীকার করেন, তিনি জনগণের বিশ্বাস থেকে চিরতরে মুছে যান। ইতিহাস অমর, কিন্তু বিকৃতিকারীর নাম মানুষ অবমাননার তালিকায় লিখে রাখে। তাই যারা জুলাই সনদের রাজনৈতিক ভিত্তিকে অস্বীকার করে, তারা কেবল ইতিহাসের নয় নিজেদেরও শত্রু।

 

 

No comments found