হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বেলাই বিল গিলছে ভূমিদস্যুরা..

MD MOLLAH avatar   
MD MOLLAH
****

হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বেলাই বিল গিলছে ভূমিদস্যুরা
হুমকিতে জীবিকা ও পরিবেশ, প্রশাসন অসহায়


কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি:

উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা এবং প্রশাসনের বাধাকে উপেক্ষা করে গাজীপুরের টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের নলছাটা অংশে চলছে ঐতিহ্যবাহী বেলাই বিল ভরাটের মহাযজ্ঞ। নর্থ সাউথ গ্রুপ ও তেপান্তর গ্রুপ নামের দুটি প্রভাবশালী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই সরকারি জলাধার দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এদের মধ্যে তেপান্তর কিছুটা কোনঠাসা থাকলেও দখলে অনেকটাই এগিয়ে নর্থ সাউথ গ্রুপ। রাতের আঁধারে শুরু হওয়া এই ধ্বংসযজ্ঞ এখন দিনদুপুরেও চলছে প্রকাশ্যে। এর ফলে বিলপাড়ের হাজারো কৃষক-জেলে তাদের জমি ও একমাত্র জীবিকা হারানোর চরম শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন, আর গাজীপুরের ‘ফুসফুস’ খ্যাত এই বিলটির পরিবেশ ও জীববৈচিত্র পড়েছে অস্তিত্বের সংকটে।

সরেজমিনে দেখা যায়, টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের পাশ ঘেঁষে নলছাটা এলাকায় বিল-বেলাইয়ে নিজেদের সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে নর্থ সাউথ ও তেপান্তর গ্রুপ। কিছুদিন আগেও রাতের আঁধারে বালু ভরাটের কাজ চললেও এখন কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই দিনে-দুপুরে ড্রাম ট্রাক দিয়ে বালু ভরাটের কাজ চলছে। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন কয়েক দফায় অভিযান চালিয়ে বালু ভরাটের সরঞ্জাম, যেমন লোহার পাইপ, ডাম্প ট্রাক ও ভেকু জব্দ করলেও তা কার্যত কোনো প্রভাব ফেলেনি। অভিযান শেষে কিছুদিন কাজ বন্ধ রেখে আরও দ্বিগুণ গতিতে শুরু হয় বিল ভরাট।

এই দখলদারিত্ব চলছে হাইকোর্টের সরাসরি আদেশ অমান্য করে। ২০১৯ সালে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বেলাই বিলের যেকোনো ধরনের ভরাট, দখল এবং শ্রেণি পরিবর্তনের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন। কিন্তু সেই আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নর্থ সাউথ গ্রুপ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করলেও মূল হোতারা বরাবরই থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত বছর অভিযান চালিয়ে কয়েকজন কর্মচারীকে কারাদণ্ড দেওয়া হলেও বালু ভরাট বন্ধ করা যায়নি।

ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই কোম্পানিগুলো স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দালাল হিসেবে নিয়োগ করেছে। এই দালালরা কৃষকদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে নামমাত্র মূল্যে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করছে। অনেক ক্ষেত্রে, জমির পুরো টাকা পরিশোধ না করেই, কেবল বায়নাপত্র করেই জোরপূর্বক জমি ভরাট শুরু করে দেয়।

উপজেলার তুমলিয়া ইউনিয়নের দড়িপাড়া গ্রামের এক বাসিন্দা রিতা পালমা বলেন, “ এই এলাকায় সাইদুল নামে এক ব্যাক্তি আছে যে নর্থ সাউথ গ্রুপের দালাল হিসেবে কাজ করছে। সে প্রথমে আমাকে জমি বিক্রির প্রলোভন দেখায়। যখন আমি কোনভাবে রাজি হচ্ছিলাম না তখন শুরু হয় ভয়ভীতি দেখানো। পরে বিষয়টি আমি উপজেলা প্রশাসন এবং থানা প্রশাসনকে জানালে তারা তাদের ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। গত বছর রাতের আঁধারে আমার জায়গায় বালু ফেললেও এবং দিনের বেলায় ড্রাম্প ট্রাক দিয়ে বালু ভরাট করছে। আমি এ ব্যাপারে কোন সমাধান এখনও পাইনি।” 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক ভুক্তভোগী বলেন, “৪-৫ বছর আগে আমার চার বিঘা জমি ১ কোটি টাকা দাম বলে কিনে নেয়। পরে আমাকে মাত্র ২২ লাখ টাকা দিয়ে জমি ভরাট করে ফেলে। বাকি টাকা আজও পাইনি, চাইতে গেলে টালবাহানা করে।” কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

নর্থ সাউথ গ্রুপের দাপটের একটি উদাহরণ হলো বিলের মধ্যে তাদের তৈরি করা একটি অবৈধ স্থাপনায় (সাইট অফিস নামে পরিচিত) বিদ্যুৎ সংযোগ। কালীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি প্রথমে আদালতের নির্দেশে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করলেও পরে রহস্যজনকভাবে তা পুনরায় স্থাপন করে। এ নিয়ে জনমনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে কালীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুতের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) আক্তার হোসেনের যুক্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেই যে কাউকে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে তারা বাধ্য। তবে একটি অবৈধ স্থাপনায় কীভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়, সেই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। এই ঘটনা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভূমিদস্যুদের আঁতাতের আশঙ্কাকে আরও ঘনীভূত করেছে।

তিনি আরো বলেন, আমাকে যদি ইউএও মহোদয় নির্দেশ দেয় তাহলে অবশ্যই আমি এই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিবো। সরকারী নির্দেশনা ছাড়া আমার পক্ষে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। 

গত বছর ৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় দৈনিক “আজকের পত্রিকা”-য় এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু তাতেও কোনো প্রতিকার মেলেনি। বরং সময়ের সাথে সাথে তাদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়েছে।

বেলাই বিল কেবল একটি জলাধার নয়, এটি গাজীপুরের একটি বিশাল অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার প্রাকৃতিক ঢাল। দেশি মাছের অন্যতম প্রধান উৎস হওয়ায় এই বিলকে কেন্দ্র করে হাজারো জেলের জীবিকা নির্বাহ হয়। শুষ্ক মৌসুমে বিলের পানি ব্যবহার করে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বোরো ধানের চাষ হয়, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

স্থানীয় পরিবেশবাদীরা বলছেন, অতীতে বিল বেলাইয়ের আয়তন ৫০ বর্গকিলোমিটার ছিলো যা দখল হতে হতে এখন মাত্র ৮ বর্গকিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। বিলটি সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে গেলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। প্রথমত, এই অঞ্চলের প্রাণী ও উদ্ভিদের জীববৈচিত্র চিরতরে হারিয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, বিলপাড়ের হাজারো জেলে পরিবার কর্মহীন হয়ে পড়বে, যা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। তৃতীয়ত, দেশের অন্যতম ধান উৎপাদনকারী এই অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, যার প্রভাব পড়বে জাতীয় খাদ্য উৎপাদনে। সর্বোপরি, বর্ষা মৌসুমে পানি ধারণের এই প্রাকৃতিক আধারটি হারিয়ে গেলে গাজীপুর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় জলাবদ্ধতা এবং বন্যার প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করবে।

এই পরিস্থিতিতে গাজীপুরের কালীগঞ্জের সাধারণ মানুষ তাদের শেষ সম্বলটুকু রক্ষা করতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। তাদের দাবি, বিচ্ছিন্ন অভিযান বা সামান্য জরিমানা করে এই প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের থামানো সম্ভব নয়। বেলাই বিলকে বাঁচাতে হলে এবং হাজারো মানুষের জীবিকা রক্ষা করতে হলে এখনই একটি সমন্বিত এবং শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, নতুবা অচিরেই এই ঐতিহ্যবাহী বিলটি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।

এ বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তনিমা আফ্রাদ বলেন, বিল বেলাইকে রক্ষায় স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা যখনই জানতে পারছি তারা বিল ভরাটের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে আমরা তখনই অভিযান পরিচালনা করি। এখন পর্যন্ত তাদের বহু টাকার মালামাল জব্দ করেছি। বেশ কয়েকজনকে আটক করে জরিমানাসহ জেল হাজতে প্রেরণ করেছি। বিল বেলাই রক্ষায় আমরা বদ্ধ পরিকর। এ ব্যাপারে আমি স্থানীয় বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করে বলতে চাই, কাউকে বিন্দু পরিমান ছাড় দেওয়া হবেনা সে যত বড় ব্যাক্তিই হউক।

বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যাপারে তিনি জানান, ডিজিএম এর সাথে কথা বলে খুব শীঘ্রই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

মোঃ ওমর আলী মোল্যা 

মোবাইল -০১৭২৯৮৩৭৮৯৩

কালীগঞ্জ গাজীপুর 

Nessun commento trovato