মৃদু বাতাসের সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিলো, শহরের রাস্তাগুলো যেন ধুয়ে দিচ্ছিল পুরনো স্মৃতির মতো।
স্মরণ দাঁড়িয়ে ছিল সেই ভার্সিটি গেটের সামনে —যেখানে তারা প্রায়ই রঙিন চায়ের কাপে সময় কাটাতো, সম্পর্কের শুরু থেকেই ।
আজ, বছর দুয়েক পর, স্মরণ দেশে ফিরে ইউনিভার্সিটিতে সৌজন্য সাক্ষাতে এসেছে ; বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সেই একই জায়গায় হঠাৎ ঈশিতাকে দেখতে পেলো।
স্মরণ আসবে শুনেই, সে দাঁড়িয়ে ছিল ছাতা ছাড়াই। দেখার সাথে সাথে ঠিক শেষদিনের মতোই — স্মরণের চোখের কোণ বেয়ে তখনও যেন অশ্রু গড়াচ্ছিল।
"বৃষ্টির ধারায় ভিজে যায় পথ,
তবু হাত ধরে রাখি—
ভিজুক পৃথিবী, ভিজুক আকাশ,
তুমি তো আমার আঁখি।"
স্মরণ ধীরে কাছে গিয়ে বলল— “তুমি এখনো ছাতা আনো না? নাকি বৃষ্টি ভেজা অভ্যেসটা থেকে গেছে? এখনো নিজের প্রতি অযত্নশীল! ”
ঈশিতা তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর হাসল কষ্টে। — “বৃষ্টিতে ভিজে গেলে তুমি আরেকটু কাছাকাছি আসতে, মনে আছে?”
স্মরণ মৃদু হেসে বলল—
“তোমার চোখের ভেতর বর্ষা জমে আছে আজও।
তুমি কি জানো?
যখন ঝরে যায় বৃষ্টি ধরণীর বুকে,
তখনো তোমার কথা ফিরে ফিরে আসে সুখে।”
ঈশিতা একটুও না চমকে শুধুই বলে ফেলল— “তুমি এখনো কবিতা লেখো?”
স্মরণ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল—
“তুমি তো আমার ভেতরের কবিতাই ছিলে,
হারিয়েছিলাম শুধু পাতাগুলো।”
একটা নিরবতা নামল, শুধু বৃষ্টির শব্দ।
স্মরণ হঠাৎ বলল— “তুমি কি মনে রেখেছো সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লাইনটা— যেতে নাহি দিব হে, তবু যেতে দিতে হয়...”
ঈশিতা ধীরে মাথা নাড়ল।
আবার জিজ্ঞেস করল— “মনে আছে? আমার জন্মদিনের দিন তুমি বলেছিলে— ‘তুমি আমার প্রথম সকাল।'
আমি বলেছিলাম— আমার সৃষ্টিকর্তার দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার তুমি। জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, তুমি আমার মানসিক প্রশান্তি, রক্ত জবা গুঁজে দিয়েছিলাম তোমার কানে । সারাজীবন ঠিক এমন হাসিখুশি থাকার ইচ্ছাটাই আমার চাওয়া ছিলো; আর তোমার চাওয়া ছিলো একটা করে হলুদ গোলাপ।
তোমার কি মনে আছে? দুদিন পরেই আমাকে জড়িয়ে ধরে তুমি কেঁদেছিলে তোমার অতীত নিয়ে? আমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম - 'আমি আছি তো!'
অযথা কতগুলো স্বপ্ন দেখিয়েছিলে আমাকে? মিথ্যে মায়ার অভিনয়েও সেরা অভিনেত্রীর ভূমিকা পালন করেছিলে।”
— "আমাকে কাদিঁয়েছো প্রতিদিন। আমার অনুভূতিগুলো ছিলো তোমার কাছে মূল্যহীন। গুটিকয়েক দিনের মধ্যেই ভালো লাগার পরিবর্তন ঘটলো তোমার; অযথাই - ভিত্তিহীন একটা কারণ দেখিয়ে হাত ছেড়ে দিলে।
—'ভালোবাসা দূরে যায় না কখনো,
থাকে নিঃশ্বাসে, চুপচাপ ক্ষণে ক্ষণে।
বিচ্ছেদেই থাকে কেবল দূরত্ব,
প্রেম তো বাঁধে চির বন্ধনসূত্র।' ”
আবারও স্মরণ বলল—
"তুই আমার ভিঁজে দুপুর,
তুই আমার খসে পড়া পাতার শূন্য সুর।
তোর একফোঁটা হাসি পেলে আমি বর্ষা হয়ে যাই আবার,
নীরব -নির্জন....।"
ঈশিতা কিছু না বলে এগিয়ে এলো এক পা, দু’পা। হঠাৎ তারা দু’জনেই একসাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে। ছাতা তখনও নেই, দুজনেই ভিজেঁ গিয়েছে ।
চোখে চোখ পড়তেই ঈশিতা বলল— “তুমি কি আবার চলে যাবে?”
স্মরণ উত্তর দিল— “হ্যাঁ। সেদিন তোমার ছেড়ে যাওয়া, আমার উম্মাদ হয়ে থাকা, তীব্র উগ্রতায় থাকা প্রতিটি মুহূর্ত স্বাক্ষী - কতটা বিষাদময় আগ্নেয়গিরিতে আমাকে ছুড়ে ফেলেছিলে। রবি ঠাকুরের মতোই আমার কাছেও মনে হতো -
চলে যাওয়া মানে নয় হারিয়ে যাওয়া,
চলে যাওয়া মানে নয় ফুরিয়ে যাওয়া।
তবে কতটা আঘাত করেছো আমার হৃদয়ে, কতটা অশ্রু ঝড়েছে , আর সেই অশ্রু লুকিয়েছে, এই বৃষ্টি।
ঈশিতা, একটু দেখা করার কতটা মিনতি ছিলো আমার, মনে আছে? আমায় অশ্রুসিক্ত করে তুমি হেসেছিলে! মেনে নিচ্ছি -আমি ব্যাক্তি হিসেবে পুরোপুরি মূল্যহীন ছিলাম তোমার কাছে। তবে, আমি তো - ভালোবাসেছিলাম, ভালোবাসি আর ভালোবাসবও। তবে এই অনুভূতি একান্তই আমার থাকবে: একান্তই আমার। বলেছিলাম —
'তোমারে যে সৃষ্টি করেছেন,
সে সৃষ্টিকর্তা আমারও।
তোমার চোখে যে আলো জ্বলে,
তা দেখার মতো চোখ আমারও।
তুমি দিয়েছিলে আঘাত, চুপিচুপি, নীরবতায়,
আমি রেখেছিলাম সহ্য—সৃষ্টিকর্তার প্রার্থনায়।
কিন্তু আঘাতের প্রতিঘাত তিনি ফেরান,
নিঠুরতার ন্যায়-বিচার নিরব প্রতীক্ষায়।
ভেবো না, ভালোবাসা ছিল একতরফা কিংবা ভুল,
সৃষ্টিকর্তা দেখেন—কে স্নেহ করল, আর কে করল খুন।'”
ঈশিতা নিরব দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্মরণের চোখে। —
"এতটা অভিযোগ জমিয়ে রেখেছো? আচ্ছা! আরেকটা বার..."— বলেই স্মরণের বৃষ্টি ভেজা শীতল হাত দু'টো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে; চুপ হয়ে গেলো ঈশিতা।
আবেগাপ্লুত কন্ঠে স্মরণ হঠাৎ বললো—
"বৃষ্টিভেজা রাতের গল্পগুলো
তোমার নামে কাঁদে,
একটি ফোঁটা আমার চোখে,
একটি ফোঁটা তোমার ছাদে—
মাঝখানে শুধুই দূরত্বের সাগর।"
"একটা কথা মনে রাখবে,—তোমাকে ছেড়ে থাকায় অভ্যস্ত আমায় তুমিই করেছো। আমি বলেছিলাম, তুমি একান্তই আমার, খুবই শখের- আপনজন। কিন্তু তোমার জীবনে আমি কেবল প্রয়োজনই ছিলাম।
—'ছেড়ে যাওয়ার হাজারো পথ, যুক্তির ভীড়ে হাঁটা,
তবু ভালোবাসা থাকলেই—থেকে যাওয়াটাই যথার্থ চাওয়া।'
—তোমার প্রার্থনায় ছিলো দূরত্ব;
আমার ছিলে শুধুই তুমি"
—"তোমার কাছে আমাদের সম্পর্কের কোনো নাম ছিলো না। কিন্তু আমার কাছে তুমি ছিলে গোটা পৃথিবী। কাল বিকেলের ফ্লাইটেই আমি আবার অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাচ্ছি। ভালো থাকবে!"
[বৃষ্টি থেমে এসেছে ধীরে ধীরে।ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাজির, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে -স্মরণ গাড়িতে উঠে পরল। ঈশিতা শুধু চুপ করেই থাকল; তবে ঈশিতা খেয়াল করল- তার দেয়া আঙটি এবং ব্রেসলেটটা এখনও স্মরণ হাতে অতি যত্নে আগলে রেখেছে। ঈশিতা সেদিন অনুভব করলো- মরীচিকার পিছনে ছুটতে - ছুটতেই ঈশিতা তার স্মরণকে হারিয়েছে; হারিয়েছে জীবনের ছন্দ - আনন্দ - ভালোবাসা।
গাড়ির লুকিং গ্লাস থেকে স্মরণের অশ্রুসিক্ত চোখ ঈশিতাকে দেখছে; স্তম্ভিত হয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টিস্নাত অবস্থায়ই -ঠিক দু'বছর আগে যেমনভাবে সে নিজে দাঁড়িয়ে ছিল।]
লেখা:
সিফাত আল সাদ,
শিক্ষার্থী,
স্নাতকোত্তর,
শান্তি, সংঘর্ষ ও মানবাধিকার অধ্যয়ন,
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি),
ঢাকা