দরিদ্রতার কারণে কলেজ পড়ুয়া মেধাবী ছাত্রী নাসরিন কাজ করেন খাবার হোটেলে
সজিবুল ইসলাম পাভেল, কালাই(জয়পুরহাট) প্রতিনিধি :
হাজারো খাবার হোটেলের ভিড়ে চোখ থেমে যায় ছোট্ট একটি হোটেলে, যেটিতে কাজ করছেন ১৮ বছরের কলেজ পড়ুয়া এক মেধাবী ছাত্রী। যার নাম নাসরিন আক্তার (১৮)। তার নামেই হোটেলটির নামকরণ করা হয়েছে "নাসরিন হোটেল"। বাবার সাথে খুবই ছোট্ট পরিসরে দীর্ঘ ৫ বছর ধরে এই হোটেল চালাচ্ছেন মেধাবী কলেজ ছাত্রী নাসরিন আক্তার (১৮)। ১২ বছর আগে হোটেলটি চালু করেছিলেন তার বাবা মোকাব্বর মন্ডল(৫৫)।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বৈরাগীহাট মোড়ে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে নাসরিন হোটেল। এই হোটেল চালিয়েই সংসার ও পড়াশুনার খরচ চালান নাসরিন। নাসরিন এসএসসি পরীক্ষায় পেয়েছিলেন এ+। তিনি বর্তমানে উপজেলার কালাই সরকারি মহিলা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী।
বাবাকে সাহায্য করতে শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এই মেধাবী শিক্ষার্থী বাবার সাথে চালিয়ে যাচ্ছেন খাবার হোটেলটি। বর্তমানে চাকচিক্যতার ভিড়ে নিজের হোটেলটি টিকিয়ে রাখতে রীতিমতো ঘাম ঝড়াচ্ছেন। এলাকার বিভিন্ন মানুষের কটু কথা শুনেও দমে যাননি এই সংগ্রামী মেধাবী কলেজ শিক্ষার্থী । নিজেই তৈরী করছেন পুড়ি,পিয়াজি, সিজ্ঞারা, চামুচা,মোগলাই, চানাচুর। রান্না করছেন ভাত, মাছ,মাংসসহ হরেক রকমের তরকারি। আবার নিজেই করছেন খাবার পরিবেশন।
স্বল্প মূল্যে সু-স্বাদু খাবার পরিবেশন করায় বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাস্টমাররা ছুটে আসে তার হোটেলে। খাবার খেতে আসা কাস্টমরা বলছেন এই হোটেলের খাবার দামে কম মানে ভালো ও সুস্বাদু।
হোটেল এ খাবার খেতে আসা ট্রাকচালক হাফিজুল ইসলাম বলেন, আমার বাড়ি বগুড়া। আমি এই এলাকায় আসি কারণ গাড়ি চালাই। আমি এখানে আসছি গাড়ি লোড করতে।আমি এই হোটেলে খেলাম খাবারের মান ভালো, পাকশাক ও ভালো।
খাবার খেতে আসা হরেক মালের ব্যবসায়ী মোখলেছুর রহমান বলেন আমার বাসা দিনাজপুর আমি এইদিকে হরেক মালের ব্যবসা করি। এই হোটেলে খাওয়া দাওয়া করি। সকালবেলা খিচুড়ি খেয়েছি, দুপুরবেলা ভাত খাইলাম ডিম ভাজি, ডাল, ভর্তা দিয়ে অনেক ভালো লাগলো।
পাশের মুদি দোকানী জিহাদুল ইসলাম বলেন, আমার পাশেই নাসরিন হোটেল। তাদের হোটেলে আর্থিক সমস্যার কারণে তারা কোন কারিগর বা মেসিয়ার রাখতে পারেনা। বিধায় মেয়ে হয়েও সে তার বাবার হোটেলের যাবতীয় সবকিছু বানায়। সে পড়াশোনা ও করে। সে একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। এসএসসিতে এ+ পেয়েছিল।
কলেজ শিক্ষার্থী নাসরিন আক্তার বলেন, আমার বাবা গরীব মানুষ। আমাদের হোটেলটি খুব ছোট। বাবা টাকার অভাবে হোটেলে কারিগর রাখেনা কারন কারিগর রাখতে হলে তাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমান টাকা দিতে হবে। যেটা আমার বাবা দিতে পারবেনা। তাই আমি নিজেই ঐ কাজগুলো করি। আমি স্কুলে পড়াশুনার সময় তখনকার কারিগরের কাছে কাজগুলো শিখেছি। আমি কালাই সরকারি মহিলা কলেজে পড়ি।আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। আমি ভোর ৫ টা থেকে ৮ টা পর্যন্ত কাজ করে কলেজে যাই। এরপর কলেজ ছুটি দিলে ৩ টার দিকে বাড়িতে আসি। তারপর বিকাল ৪ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত হোটেলে কাজ করি। মা -বাবার কাজে সাহায্যের জন্য কাজ করি। দিনে ৩-৪ হাজার টাকা বেচাকেনা হয়।
নাসরিন আক্তারের বাবা মোকাব্বর মন্ডল বলেন, আমার মেয়ে কালাই মহিলা কলেজ পড়ে। সকালে কাজ শেষ করে কলেজে যায়। কলেজ থেকে ফিরে এসে বিকাল থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত কাজ করে। আমার মেয়েই আমাকে সব কাজে সহযোগিতা করে।মেয়ে হয়েও আমাকে একজন ছেলের মতই কাজে সহযোগিতা করে এতে আমি গর্বিত।
কালাই সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ নাজিম উদ্দিন বলেন, সে ব্যবসা করে লেখাপড়া চালায় এবং কস্টের মধ্যে দিয়ে লেখাপড়া করেই এসএসসি পাশ করে এখানে ভর্তি হয়েছে। শুনে আমি খুব অবাক বিস্ময়ে তাকালাম, এই মেয়েটা তো খুব মেধাবী। এই মেয়েটাকে সহযোগিতা করলে কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।
এ বিষয়ে কালাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শামিমা আক্তার জাহান বলেন, বৈরাগীর মোড়ে নাসরিন হোটেলে নাসরিন নামে যে মেয়েটির কথা শুনলাম সে তার পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার সাথে বাবার হোটেলে কাজ করছে এটা একটা চমৎকার উদ্যোগ। তবে তার পড়ালেখার যেন ক্ষতি না হয় এই কাজটা করতে যেয়ে। সেজন্য তাকে যতটুকু আর্থিক সহযোগিতা আমাদের উপজেলা প্রশাসন থেকে করা প্রয়োজন সেটা আমরা করবো।
পরিবারকে সাহায্যের জন্য অল্প বয়সে খাবার হোটেলে কাজ করতে গিয়ে ও পড়াশুনা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন নাসরিন। তবুও তার সপ্ন উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করে মেডিক্যাল এ পড়াশুনা করা। নাসরিনের মত মেধাবী শিক্ষার্থীরা পরিবার ও দেশের জন্য সম্পদ।