তবে সেই দৃঢ় লড়াইয়ের পেছনেও ছিল আরেকটি কণ্ঠ—নীরবে, আড়ালে। তাঁর স্ত্রী পূজা পূজারা। চেতেশ্বর মাঠে যুদ্ধ করতেন, আর পূজা নীরবে সেই যুদ্ধের গল্প লিখে রাখতেন নিজের ডায়েরিতে। অনেকটা নিজের সঙ্গেই কথা বলা যেন। আর সেই চুপচাপ লেখা কথাগুলোরই পরিণতি এখন একটি বই—‘দ্য ডায়েরি অব আ ক্রিকেটার’স ওয়াইফ’।
পূজার নিজের জীবনটাও কিন্তু কম চমকপ্রদ নয়। বিয়ের আগে ক্রিকেট সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না তাঁর। চেতেশ্বরের নামও শোনেননি। করপোরেট জগতে ছিলেন, এমবিএ শেষ করে চাকরি করছিলেন পছন্দের জায়গায়। কিন্তু বিয়ের পর সবকিছু বদলে যায়। চেতেশ্বরের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ক্রিকেট, আর পূজা ধীরে ধীরে শুধু স্বামী নয়, ক্রিকেটকেও ভালোবেসে ফেলেন।
দম্পতির প্রথম সন্তানের জন্মের পর করপোরেট পেশায় ফিরতে চাইলেও সময় আর সুযোগ মেলেনি। তখনই চেতেশ্বরের ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। আর খেলোয়াড় স্বামীর সঙ্গে ট্যুরে গেলে হাতে পাওয়া ফাঁকা সময়েই লিখতে শুরু করেন সেই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো—কখনো শ্বশুরের গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে, কখনো নিজের অভিজ্ঞতা থেকে।
২০২১ সালে একদিন চেতেশ্বর বলেই ফেললেন, "এসব লেখা দিয়ে একটা বই বানাও না!" যদিও পূজার মনের কোণায় সেই ইচ্ছেটা আগেই ছিল, কাউকে বলেননি কখনো। এবার আর থামলেন না।
বইটি শুধু একজন খেলোয়াড়ের উত্থান নয়, তার পতনের কথাও বলে। পূজা শুরুতেই চেতেশ্বরকে আশ্বস্ত করেছিলেন—তাকে নিখুঁত নায়ক হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে তুলে ধরবেন। সেই মানুষ যার ব্যর্থতা আছে, ক্লান্তি আছে, অভিমানও আছে।
২০১৫ সালে সিডনি টেস্ট থেকে বাদ পড়ার পর চেতেশ্বর খবরটিও দেননি স্ত্রীকে। পূজা তখন অস্ট্রেলিয়াতেই, মনখারাপ এতটাই হয়েছিল যে খেলা দেখতে যাওয়ার মনও হয়নি। পরে অবশ্য বুঝেছিলেন, তাঁর নিজেকে ভেঙে ফেলা মানেই স্বামীর ওপর চাপ আরও বাড়ানো। তখন থেকেই সিদ্ধান্ত—নিজের যন্ত্রণা চেপে রেখে যতটা সম্ভব শক্ত থাকার চেষ্টা করবেন।
তাঁর ভাষায়, “একটা দলে খেলতে পারে মাত্র ১১ জন। একজন সুযোগ পেলে অন্যরা বাদ পড়বেই। এই বাস্তবতা মেনে নিতে সময় লেগেছে।”
চেতেশ্বর সবসময় নিজের কষ্ট গোপন রাখতেন, পরিবারের সামনে হাসিমুখে থাকতেন। কিন্তু পূজা বোঝতেন—এই মানুষটারও প্রয়োজন আছে কাউকে মন খুলে কিছু বলার। একবার বলেছিলেন, “তুমি এখন তো খেলছো না, চলো, একটু কথা বলি।” ওই কথোপকথন চেতেশ্বরের কাছে ছিল যেন এক ধরনের কাউন্সেলিং।
২০২১ সালের ব্রিসবেন টেস্টে পূজারার ইনিংস ক্রিকেট ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। মিচেল স্টার্ক, হ্যাজলউড, কামিন্সদের বিপক্ষে শরীর দিয়ে বল ঠেকিয়ে ৫৬ রান করে দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। অনেকের কাছে সেই ইনিংস অনুপ্রেরণার, কিন্তু পূজার কাছে ছিল আতঙ্ক। ফোনে ফিজিও থেকে ম্যানেজার—সবার কাছে মেসেজ পাঠাচ্ছিলেন, “ও কেমন আছে?”
খেলা শেষে চেতেশ্বর একটি ছোট মেসেজে জানালেন, “আমি ঠিক আছি।” ব্যথা ছিল ঠিকই, কিন্তু তাঁর মতে, সেটা ছিল “মিষ্টি ব্যথা”—কারণ ভারত ম্যাচ ও সিরিজ জিতেছিল।
২০২৩ সালের জুনে ওভালে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে পূজারার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার যেন দাঁড়িয়ে যায় এক অজানা থেমে যাওয়া’র মুখে। এরপর দলে ফিরতে পারেননি। তখন পূজা পরামর্শ দিয়েছিলেন কোচিং বা ধারাভাষ্য ভাবতে। প্রথমে রাজি না হলেও পরে সেই পথে হাঁটেন পূজারা। এখন ইএসপিএন-ক্রিকইনফোর মতো বড় প্ল্যাটফর্মে ধারাভাষ্য দেন, ক্রিকেটকে দেখেন নতুন চোখে।
৩৭ বছর বয়স হলেও এখনো অবসরের কথা ভাবছেন না চেতেশ্বর পূজারা। তাঁর চোখে এখনো মাঠের আলো, ব্যাট-প্যাডের শব্দ, আর নিজেকে প্রমাণের তাগিদ। পূজা যেমন বলেছিলেন, “তোমার গল্পটা অনুপ্রেরণার। কেউ না কেউ এটা পড়ে সাহস পাবে।”
আর যদি ফেরেন পূজারা, হয়তো একদিন ডায়েরির দ্বিতীয় খণ্ডও আসবে আমাদের হাতে—আরও কিছু লুকানো গল্প, আরও কিছু নীরব অনুপ্রেরণা নিয়ে।