close

ভিডিও আপলোড করুন পয়েন্ট জিতুন!

বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ঝুঁকি ও সংগ্রামের গল্প- সিনিয়র সাংবাদিক সাইদুর রহমান..

শেখ আমিনুর হোসেন, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, সাতক্ষীরা avatar   
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশার ঝুঁকি, সংগ্রাম এবং সত্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের বিশদ বিবরণ..

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোন অন্যায় এবং অবিচারের প্রতিবাদে সাংবাদিকদের থাকতে হয় অগ্রভাগে। বলতে গেলে জীবনের নিশ্চয়তা নেই। নেই আর্থিক স্বচ্ছলতা। সার্বক্ষণিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগুতে হয়। দলীয় রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তির কারণে দিনদিন সাংবাদিকতা আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তবু কিসের নেশায় কিসের আশায় যে, এই পেশাটি ছাড়তে পারি না তা জানি না। তবে যতদিন বেঁচে আছি মানুষের সেবায়, জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবো। 

আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া। দু'দফা মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনাকালীন ২০০৪ সালের ডিসেম্বর থেকে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। সাংবাদিকতার কারণে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছি। এজন্য আমাকে হত্যার পরিকল্পনাও করা হয়। তবু বেঁচে আছি। হত্যা করে কখনোই কন্ঠরোধ করা যায় না, যাবে না। এই হত্যার রাজনীতি বাংলাদেশে চলবে না। 

আমার এখনো দু,টি হত্যার পরিকল্পনার কথা মনে পড়লেই গা শিউরে ওঠে। একটি ২০২২ সালের ঘটনা। সাতক্ষীরার কলারোয়ার হাসপাতাল রোডে কিছু আওয়ামী লীগের টোকাইদের বড় অংকের টাকায় ভাড়া করা হয়। তাদের টাকাও দেয়া হয়। যিনি ভাড়া করেন তিনি আমার পূর্বপরিচিত। আমি ঈদে বা অন্য সময়ে বাড়ি গেলে কলারোয়ার সেখানে দেখবে সেখানেই মারবে। এই চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে তারা আমার পরিচিত একজনের সাথে আলাপ করলে তিনি প্রক্রিয়া ভেস্তে দেন। তাদের বলেন, যাকে মারবি, তাকে চিনিস, সে সাংবাদিক। হজম করতে পারবি না। পরে তারা ভয় পেয়ে যান। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সেই বড় ভাই টেলিফোনে জানান, তোমাকে মারার পরিকল্পনা হয়েছে। আমার সামনে আলোচনা হলে তা বন্ধ করে দিয়েছি। সাবধানে থেকো। 

আরেকটি হত্যার পরিকল্পনা হয় সম্প্রতি। যিনি আমাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তি। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর সেই ব্যক্তির বাসায় আমার যাতায়াত ছিলো। আমি এবং সেই ব্যক্তি দুইজন বসে আছি। হঠাৎ ওই ব্যক্তির টেলিফোনে অপরিচিত নম্বরে ফোন। কথা শেষে তিনি বললেন, নম্বরটি কার জানো। আমি বললাম কার? তিনি জানালেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী অমুকের। এমনকি নম্বরটি আমাকে সেভ করেও দিতেন বলেন। এর মধ্যে অন্যায়, অবিচার, অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহকে কেন্দ্র করে কারণে সেই বক্তির সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়। চরম অবনতি হয়। কিন্তু সেটি হত্যার পরিকল্পনায় গিয়ে ঠেকবে তা কখনোই কল্পনা করেনি। যাই হোক আমার অতি পরিচিত ঢাবি ক্যাম্পাসের এক বড় ভাই বারবার ফোন দেন, দেখা করতে বলেন। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সময়মতো দেখা করা হয়নি। পরে দেখা হলে ভাই বলেন, তুই সাবধানে থাকিস। তোরে ফেলার কন্ট্রাক্ট হয়েছে। তবে টেনশন করিস না। আপাতত সমস্যা নাই। আল্লাহ তোকে বাঁচিয়েছে। 

টেনশন করিস না বলার পর তো মহা টেনশনে। ভাই কি হয়েছে বলেন প্লিজ। ভাই বলেন, ওমুক (যে ব্যক্তির সাথে সম্পর্কের অবনতি) তোর ছবি অমুক শীর্ষ সন্ত্রাসীর কাছে পাঠিয়েছিলো। আমি বললাম কেন ভাই? সেই ভাই বললেন, ছবি পাঠিয়ে তোকে মারার কন্টাক্ট করে। আমি জানার পর ওইটা বন্ধ করে দিয়েছি। আমার পরিচিত সেই প্রভাবশালী ব্যক্তি যার মোবাইলে শীর্ষ সন্ত্রাসীর নম্বর সেভ করে দিয়েছিলাম তার কাছেই মুলত আমার ছবি পাঠানো হয়। ক্যাম্পাসের বড় ভাই যখন ঘটনা শেয়ার করেন তখন আমি পুরোটাই বাকরুদ্ধ। মানুষের এতো কুৎসিত রুপ হয় কিভাবে? সামান্য স্বার্থের জন্য হত্যাকান্ড? 

জীবনে হয়তো ভালো কিছু করেছি বলে মহান আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছি। সত্যর পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে কথা বলছি এবং লিখছি। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশে সঠিক সাংবাদিকতা সতিহ কঠিন কাজ। লেখনীর মাধ্যমে এই কঠিন কাজকে সহজ করতে হবে। সত্য তুলে ধরতে হবে, সমাজ পরিবর্তন ঘটাতে হবে। 

মনখারাপ হলে মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়িতে যায়। দাদা-দাদির কবর দেখি  বাবা-মায়ের দোয়া নেয়। তাছাড়া মারা যাওয়ার পরতো কবরটি সেই আমার গ্রামেই হবে। এজন্য গ্রামের প্রতি এতো টান। কিছুদিন হলো হঠাৎ সকালে আমার বাবা বললেন, আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আমি বললাম কেন? বললেন, তোর জন্য। কি হয়েছে আব্বা বলো, তিনি বললেন, রাতে খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। তোকে কে বা কারা মেরে ফেলেছে। অঝোরে কান্না। আমি শুধু বাবা এবং মাকে বললাম, আমার জন্য দোয়া করো। তারা দোয়া করলেন। এবং কিছু দান খয়রত করলেন। বাবা এবং মাকে বলেছি, তোমরা দোয়া কর। তোমাদের দোয়া থাকলে পৃথিবীর কেউই কিছুই করতে পারবে না-ইনশাল্লাহ। 

সম্মান দেয়ার মালিক আল্লাহ। কাল আপনাকে কোথায় নিয়ে যাবে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া সেটি কারোর পক্ষে বলা সম্ভব না। আপনার চাওয়ার ভীতরে যদি সততা থাকে তাহলে লক্ষ্য পৌঁছে যাবেন নিশ্চিত। আমার পুরো জীবনটাই সংগ্রামের আর লড়াইয়ের। সেই লড়াই ন্যায় এবং সত্যের জন্য। 

ফ্যাসিবাদ আমলের বিগত ১৭ বছরে সাংবাদিকতায় অনেক হয়রানী, প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছি। শারীরিক, মানসিক নির্যাতন সহ্য করেছি, হামলা হয়েছে। চাকুরিচ্যুতি চেষ্টা হয়েছে বহুবার, পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছি। কিন্তু থেমে থাকে নি। কলম চালিয়ে গেছি বিরামহীনভাবে। কিন্তু আপোষ করেনি। সবাইকে মরতে হবে। আজ অথবা কাল। পৃথিবীতে জন্মেছি, অসাধ্যকে সাধন করবার জন্য। ভয় পাওয়ার জন্য নয়। প্রতিবাদ আর ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত। মিথ্যার রাজ্য ভেঙ্গে দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করবার জন্যই তো এখনও কলম ধরছি। এই কলম চলছে এবং চলবে। সুকান্ত ভট্টাচার্য-এর 'ছাড়পত্র' কবিতাংশের সেই বিখ্যাত লাইন "চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ / প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যা আমি- নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।"

লেখক পরিচিতি: সাইদুর রহমান, রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক। 

No comments found