বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই স্পর্শকাতর দুটি বিষয় হলো জাতীয় নিরাপত্তা এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক। সম্প্রতি এই দুটি প্রসঙ্গকে এক ফ্রেমে এনে তীব্র বিতর্ক উসকে দিয়েছেন ব্যারিস্টার ফুয়াদ। একটি টেলিভিশন আলোচনায় তিনি সরাসরি দাবি করেছেন যে, আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় পড়ে না, বরং এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য একটি ‘জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি’। একইসঙ্গে, তিনি মন্তব্য করেন যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘মৈত্রী চুক্তির নামে’ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভারতের কাছে ‘বিক্রি করে দিয়েছিলেন’, যার ফলে তিনি 'মীরজাফরের' ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তার এই বক্তব্য দেশের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ব্যারিস্টার ফুয়াদ তার বক্তব্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার মতে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় পড়ে না।
তিনি যুক্তি দেন:
"আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দলের ডেফিনেশনে পড়ে না, সে হচ্ছে সে হচ্ছে একটা ন্যাশনাল সিকিউরিটি থ্রেট, জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি।"
এই দাবির স্বপক্ষে তিনি পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানেও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে রাশিয়ার ‘আরটি’ বা ইরানের ‘প্রেস টেলিভিশন’-এর মতো গণমাধ্যমকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তার মতে, এই সকল ক্ষেত্রে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করাই ছিল মূল কারণ।
ব্যারিস্টার ফুয়াদ আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকেই একে দেশের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি দলটির জন্ম (২৩ জুন, ১৯৪৯, পলাশী দিবস) কে কাকতালীয় নয় বরং ‘আজন্ম পাপ’ হিসেবে অভিহিত করেন।
তিনি দাবি করেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতির মূল ভিত্তিই হলো দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ক্ষতিসাধন করা এবং এর মধ্য দিয়েই তার রাজনৈতিক ডায়ালাইসিস সম্পন্ন হয়:
"আওয়ামী লীগের পলিটিক্যাল ডায়ালাইসিসের প্রসেস হচ্ছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস করে দিল্লীর গোলামী কায়েম করবার মধ্য দিয়ে তার রাজনীতি এবং তার রাষ্ট্র কাঠামো গঠন করা।"
আলোচনার সবচেয়ে বিতর্কিত অংশটি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা নিয়ে তার বিশ্লেষণ। ব্যারিস্টার ফুয়াদ দাবি করেন, ভারত মূলত দুটি পথে বাংলাদেশে তার ‘হেজিমনি’ বা আধিপত্য বিস্তার করে: রাজনৈতিক আধিপত্য এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য। আর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হলো অন্য দেশের রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে নিজের স্বার্থ রক্ষা করা।
১৯৭১ সালের সমঝোতা
তিনি প্রশ্ন তোলেন, ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকার গঠন নিয়ে কেন লন্ডন বা চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল (সেক্টর কমান্ডারদের প্রস্তাব) বাদ দিয়ে কলকাতায় সরকার গঠন করা হলো। তার মতে, এর ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই শুরু থেকেই ‘কম্প্রোমাইজড’ হয়েছিল। তিনি উল্লেখ করেন, মাওলানা ভাসানী কলকাতায় থাকতে চাইলেও তাকে ভারত সরকার ‘হাউস অ্যারেস্ট’ করে রেখেছিল।
শেখ মুজিব এবং ‘গোলামীর চুক্তি’
ব্যারিস্টার ফুয়াদের মতে, স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেওয়া পদক্ষেপগুলো ছিল দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য চরম ক্ষতিকর। তিনি সরাসরি মুজিব-ইন্দিরা মৈত্রী চুক্তিকে ‘গোলামীর চুক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেন।
তিনি দাবি করেন, এই চুক্তিতে সাত দফা এমন শর্ত ছিল, যেখানে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষেত্রে ভারতকে জানাতে বাধ্য থাকত, এমনকি দেশের সেনাবাহিনী বা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্যারামিলিটারি ফোর্স কী হবে, তা-ও ভারত ঠিক করে দিত।
এই প্রসঙ্গে তিনি চরম কঠোর ভাষায় বলেন:
"যে মানুষটা বাংলাদেশের গর্বিত গান্ধী হতে পারতেন, জিন্নাহ হতে পারতেন, তিনি বাংলাদেশের মীর জাফরের রোলে চলে গেছেন, দেশ বিক্রি করার লড়াই করেছেন। যে মানুষটাকে সামনে রেখে বাংলাদেশে মুক্তির লড়াই হয়েছে, সেই মানুষটাই মৈত্রী চুক্তি করে ভারতের কাছে বাংলাদেশের সভেনটি বিক্রি করে দিয়েছেন।"
আলোচনায় ব্যারিস্টার ফুয়াদ ১৯৭৫ সালের আগস্ট বিপ্লব এবং সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানকে (২০২৪/২০২৫) একই সূত্রে গাঁথেন। তার মতে, এই দুই ঐতিহাসিক ঘটনার মূল কাঠামো (কমন ফ্রেম) হলো ‘শত্রু চেনার রাজনীতি’।
তিনি দাবি করেন, ১৯৭৫ সালের আগস্টে যেমন আওয়ামী লীগ, শেখ পরিবার এবং ‘দিল্লীর গোলামরা’ পরাজিত হয়েছিল, তেমনি ২০২৪/২০২৫ সালের গণঅভ্যুত্থানেও একই শক্তির পরাজয় হয়েছে। এই দুটি ক্ষেত্রেই, তার মতে, ‘আজাদীর পক্ষের মানুষরা’ (যেমন— জিয়াউর রহমানের মতো শহীদরা) এসে দায়িত্ব নিয়েছেন।
ব্যারিস্টার ফুয়াদ এই ধারাবাহিকতাকে বাংলাদেশের বিজয়ের ইতিহাস হিসেবে আখ্যা দেন এবং বলেন, ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য এই শিক্ষাটি জরুরি যে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের শত্রুদের বারবার চিহ্নিত করতে হবে।
ব্যারিস্টার ফুয়াদের এই বক্তব্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা এবং পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে চলমান বিতর্ককে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেল। যদিও তার দাবিগুলো অত্যন্ত কঠোর এবং ঐতিহাসিক তথ্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে, তবে তার মূল বার্তাটি ছিল—জাতীয় স্বার্থে আপসহীন ঐক্য প্রতিষ্ঠা।
তিনি জোর দেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব যে দল থেকেই আসুক (বিএনপি, জামায়াত বা অন্য জোট), স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আত্মমর্যাদা, পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রতিরক্ষা নীতির প্রশ্নে কোনো মতভেদ থাকা চলবে না। পশ্চিমা দেশগুলোর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সরকার বদল হলেও যেমন যুদ্ধের নীতি বা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার নীতিতে পরিবর্তন আসে না, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই প্রশ্নগুলো হওয়া উচিত ‘কমন কোয়েশ্চেন’।
এই আলোচনা চূড়ান্তভাবে এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত বিদেশনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার মৌলিক প্রশ্নে এসে ঠেকেছে। যেকোনো নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে, এই বিতর্কিত ঐতিহাসিক দাবিগুলোর নিষ্পত্তি এবং জাতীয় স্বার্থকে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়াটাই হবে মূল চ্যালেঞ্জ।



















