ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ, অর্থনীতির রক্তক্ষরণে কে আগে ভেঙে পড়বে..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে দুই দেশই ইতোমধ্যে শতকোটি ডলার ক্ষতির মুখে। এই অর্থনৈতিক যুদ্ধে কে আগে হার মানবে? বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ—চলবে কত দিন এই ব্যয়বহুল যুদ্ধ?..

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা গড়িয়ে গেছে দ্বিতীয় সপ্তাহে। প্রতিদিনই নতুন হামলা, পাল্টা হামলা, আর মৃত্যু। কিন্তু এই লড়াইয়ের পেছনে অর্থনীতির একটা ভয়াবহ মূল্য রয়েছে, যা এখন আর অদৃশ্য নয়—বরং দিন দিন আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রশ্ন একটাই: এই বিপুল ব্যয়ের যুদ্ধ আর কতদিন চালিয়ে যেতে পারবে মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র?

১৩ জুন ভোরে ইসরায়েল চালায় একটি ভয়াবহ হামলা, যেখানে ইরানের একাধিক শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। কিছু পারমাণবিক স্থাপনাও গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পাল্টা জবাব আসে ইরান থেকেও—ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে মিসাইল হামলা, ড্রোন আক্রমণ। প্রতিটি হামলার পিছনে রয়েছে বিপুল ব্যয়, রাজনৈতিক ঝুঁকি এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা।

ইসরায়েল ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। সেই যুদ্ধ এখনো চলছে। এর মধ্যেই ইরানের সঙ্গে নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হওয়ায় অর্থনীতির ওপর চাপ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ উচ্চতায়।

ইসরায়েলের অর্থনৈতিক দৈনিক Calcalist জানায়, শুধু গাজা যুদ্ধেই ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ দেশটির ব্যয় দাঁড়াতে পারে প্রায় ৬,৭০৫ কোটি মার্কিন ডলার। আর ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের মাত্র দুই দিনেই ব্যয় হয়েছে ১৪৫ কোটি ডলার

যুদ্ধ যদি চলতেই থাকে, ইরানের সঙ্গে এই সংঘাত গাজা যুদ্ধের খরচকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের বাজেটে বড় ধরনের ঘাটতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা সামনের বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে হুমকির মুখে ফেলবে।

যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা বাড়িয়েছে (১৪,৮০০ কোটি ডলার থেকে ১৫,৪০০ কোটিতে উন্নীত), তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উদ্বিগ্ন।

বিশ্বখ্যাত রেটিং এজেন্সি S&P Global Ratings সরাসরি সতর্ক করেছে—যদি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে ইসরায়েলের ক্রেডিট রেটিং ‘A’ থেকে কমে ‘A-’ হয়ে যেতে পারে। এতে ঋণের খরচ বেড়ে যাবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে।

পর্যটন খাতে ধস নেমেছে। হাইফা বন্দর থেকে পর্যটকরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন। ব্যবসায়িক পরিবেশ ভেঙে পড়েছে—২০২৪ সালে ইসরায়েলে ৬০,০০০ কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব সংগ্রহে।

ইরানের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো তেল ও গ্যাস রপ্তানি। কিন্তু ইসরায়েলের টার্গেটেড হামলায় এই খাতটিও হুমকির মুখে।

বিশ্লেষণা সংস্থা Kpler জানিয়েছে, জুনের মাঝামাঝি সময়ে ইরানের কনডেনসেট রপ্তানি নেমে এসেছে মাত্র ১ লাখ ২ হাজার ব্যারেলে, যেখানে প্রত্যাশা ছিল দৈনিক ২ লাখ ৪২ হাজার ব্যারেল। খার্গ দ্বীপ থেকে তেল রপ্তানি একেবারেই বন্ধ।

এদিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র—সাউথ পার্স, যা ইরান ও কাতারের যৌথ মালিকানাধীন, সেখানে হামলার পর গ্যাস উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এতে ইরানের গ্যাস সরবরাহ ও বৈদেশিক আয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে।

ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ১৯৭৯ সাল থেকে চলে আসছে। যদিও ২০১৫ সালে ‘জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’ (JCPOA) স্বাক্ষরের মাধ্যমে কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়েছিল, কিন্তু ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফের কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

ফলে ইরানের তেল রপ্তানিতে ধস নামে। U.S. Energy Information Administration (EIA) বলছে, ২০২২-২৩ সালে ইরান তেল রপ্তানি করে আয় করেছে মাত্র ৫০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ২০১৬ সালের তুলনায় তা ১০ শতাংশ কম।

এর ফলে ইরানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হুমকির মুখে, আর যুদ্ধকালীন ব্যয় মেটাতে সরকারকে তেলের ওপর আরও নির্ভর করতে হচ্ছে, যা অদূর ভবিষ্যতে আরও চাপ সৃষ্টি করবে।

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত দিন দিন শুধু সামরিক নয়, অর্থনৈতিক রূপে ভয়াবহ হয়ে উঠছে। দুই দেশই প্রতিদিন হারাচ্ছে কোটি কোটি ডলার, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংঘাত অব্যাহত থাকলে উভয় দেশই একসময় নিজেদের অর্থনৈতিক পতনের মুখোমুখি হবে—যেখানে কোনো পক্ষই প্রকৃত বিজয়ী হয়ে উঠবে না।

মধ্যপ্রাচ্যের এই দ্বন্দ্ব আর শুধু রণাঙ্গনের নয়—এখন এটি রীতিমতো এক অর্থনৈতিক ‘আত্মহত্যা’। যুদ্ধের উত্তাপ যত বাড়ছে, দুই দেশের আর্থিক তাপমাত্রাও ততই বিপজ্জনকভাবে উঠছে। এই পথ কতদূর? কার ধৈর্য ভাঙবে আগে? সময়ই দেবে তার জবাব।

कोई टिप्पणी नहीं मिली


News Card Generator