বলছি, কিন্তু কর্তৃত্ববাদ চর্চা বর্জন করছি না
বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রের চর্চা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার কথা বারবার শোনা গেলেও, কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রবণতা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। সরকারগুলো গণতন্ত্রের স্লোগানকে সামনে রেখে এমন একটি কাঠামো তৈরি করছে যেখানে তাদের নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশলই প্রাধান্য পায়। এই প্রবণতা শুধু আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নয়, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও দৃশ্যমান।
গণতন্ত্র বনাম কর্তৃত্ববাদ: দ্বন্দ্বের শিকড়
কর্তৃত্ববাদ চর্চা প্রাচীন রাজনীতি থেকে শুরু হলেও, আধুনিক যুগে এটি ভিন্ন আঙ্গিকে আবির্ভূত হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত কার্যকর থাকলেও, সেই কাঠামোর মধ্যে লুকানো থাকে শাসকদের একচেটিয়া প্রভাব। গণতন্ত্রের ব্যানারে কর্তৃত্ববাদ চর্চার প্রাথমিক লক্ষ্য হলো বিরোধী দল ও মতের কণ্ঠস্বর দমন করা, মিডিয়ার স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করা এবং জনগণের অধিকারকে সীমিত করে তোলা।
বাংলাদেশে এই চর্চার বাস্তব উদাহরণ দেখা যায় সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতিতে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে বিতর্ক, বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন, এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি—এগুলো সবই নির্দেশ করে কিভাবে কর্তৃত্ববাদ চর্চা বাড়ছে।
বক্তব্য এবং কাজের অমিল
কর্তৃত্ববাদী শাসকরা জনগণের সামনে উদারতার বার্তা দিলেও, বাস্তবতায় তাদের শাসন পদ্ধতি হয় কঠোর। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা হলে, জনগণকে শান্ত রাখার জন্য সরকার বারবার প্রতিশ্রুতি দেয় "অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন"। কিন্তু নির্বাচনকালীন সহিংসতা, ভোট কারচুপি এবং বিরোধীদের কণ্ঠরোধের ঘটনা সেই প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় এই চিত্র আরও পরিষ্কার হয়েছে।
বিরোধী দলীয় সমাবেশে বাধা: বিরোধীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুলিশি হস্তক্ষেপ এবং গ্রেফতারের ঘটনা নিয়মিত খবরের শিরোনাম হচ্ছে।
মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ: সাংবাদিকদের ওপর হামলা, সংবাদ চ্যানেল বন্ধ, এবং সোশ্যাল মিডিয়া সেন্সরশিপ কর্তৃত্ববাদী চর্চার এক সুস্পষ্ট উদাহরণ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করা হচ্ছে, যা একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলনীতির পরিপন্থী।
কেন এই দ্বৈততা?
ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠী কর্তৃত্ববাদ চর্চাকে ব্যবহার করে। যদিও জনগণের সামনে গণতন্ত্রের স্লোগান তুলে ধরা হয়, বাস্তবতায় এটি একটি ছদ্মবেশ মাত্র।
ক্ষমতার প্রতি লোভ: দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকারগুলো জনগণের আস্থা হারানোর ঝুঁকি নিতে চায় না।
বিরোধী দলকে দুর্বল করা: বিরোধীদের দমন করলে ক্ষমতা টিকে থাকে বলে শাসকগোষ্ঠীর ধারণা।
আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা: আন্তর্জাতিক মহলে গণতন্ত্রের ইমেজ ধরে রাখতে সরকারের কথার চেয়ে কাজের দ্বৈততা একটি কৌশল।
জনগণের ভূমিকা এবং সম্ভাবনা
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করার জন্য জনগণের সচেতনতা এবং প্রতিরোধই মূল শক্তি। বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রসারের কারণে জনগণ শাসকগোষ্ঠীর এই চর্চার বিষয়ে সচেতন হচ্ছে। তবে, শুধুমাত্র সচেতন হওয়াই যথেষ্ট নয়; দরকার কার্যকর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ।
কর্তৃত্ববাদ চর্চা গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে গণতন্ত্রকে প্রকৃত অর্থে কার্যকর করার জন্য শাসকদের শুধু কথা নয়, কাজে সততার প্রমাণ দিতে হবে। অন্যথায়, জনগণের ক্ষোভ এবং অসন্তোষ কেবল শাসনব্যবস্থাকে আরও জটিল করে তুলবে।
লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন, লেখক ও সাংবাদিক
#গণতন্ত্র #কর্তৃত্ববাদ #বাংলাদেশরাজনীতি #মানবাধিকার #সাংবাদিকতা #মিডিয়াস্বাধীনতা #জনগণ #শাসনব্যবস্থা #সামাজিকপ্রতিবাদ #রাজনৈতিকবিশ্লেষণ