- 0
- 0
আমাদের প্রবীণ ও আমরা!

ঘটনা ১: সাহেদ সাহেব ( ছদ্ম নাম) নারায়নগঞ্জে একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজী শিক্ষক। বাড়ী ময়মনসিংহে, পরিবার ছাড়া ৩৩ বছর কাটালেন পার্শ্ববর্তী জেলায়। চাকরীকালীন সময়ে বাড়িতে ১৫দিন/ ১ মাসে বা কখনও আরো বিলম্বে এসেছেন। ফলে সন্তানদের খোঁজ খুব একটা নিতে পারেননি তবে ভালো আত্মীয় স্বজনের সুবাদে ৪ মেয়ের খুব ভালো বিয়ে দিয়েছেন। অবসরের পর যখন বাড়ী আসলেন তার স্ত্রী বিয়োগ হয় কয়েক মাস পরই। তখনো তাঁর অনেক কিছুই দেখার বাকী। ভোগ করার বাকী অনেক স্বাদ / বিস্বাদের! স্ত্রী বিয়োগে বেচারা সাহেদ সাহেব সম্পূর্ণ একা হয়ে যান। ছোট কন্যা ও একমাত্র ছেলে পড়া ও চাকরির সুবাদে বাইরে থাকায় নিদারুন একাকীত্বে অসহনীয় হয়ে উঠে তাঁর জীবন। বন্ধু, স্বজনের পড়ামর্শে চল্লিশোর্ধ এক বিধবাকে ঘরে আনেন দ্বিতীয় বিয়ের মাধ্যমে। কিন্তু সন্তানদের কেউই তাঁর এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। নিদারুন মনোঃকষ্ট নিয়ে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে এই ধরা ত্যাগ করেন তিনি।
ঘটনা ২: জিয়া সরকারের আমলে গ্রাম সরকারের প্রধান, ইউ পি সদস্য, গ্রামের গন্যমান্য দাপুটে ব্যক্তি হরমুজ মেম্বার( ছদ্ম নাম)। যার দাপটে গ্রামে পুলিশ ঢুকলেও এক সময় তার সাথে আলাপ করে নিত বলে কিংবদন্তী আছে। এই হরমুজ মেম্বারের পর পর দুই স্ত্রী বিয়োগ হয়। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে বিয়ে করে নাতি নাতনীরাও বিয়ের যোগ্য। কিন্তু সারা জীবন দাপুটে চলা মেম্বার সাহেব অনুভব করেন একাকিত্বের কষ্ট ফলে তৃতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। ঘরে আনেন মধ্য বয়সী আরেক নিসঙ্গ বিধবাকে। সন্তান, নাতী নাতনী কেউ তাঁর এই বিয়ে মেনে নেয়নি। এক পর্যায়ে তাঁর তৃতীয় স্ত্রীকে ছেলেরা কিছু টাকা পয়সা দিয়ে বাড়ি থেকে বিতারিত করেন। এক সময়ের দাপুটে হরমুজ মেম্বার তাঁর শেষ জীবন কাটান অন্যের বারান্দায়। কঠিন ঠাণ্ডার সময় পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
বাস্তব ঘটনার উপর তৈরী উপরের দুটি কেস স্টাডি বিশ্লেষন করলে আমরা দেখতে পাই সাহেদ এবং হরমুজ আলী দুজনের কেউই অভাবী নন। কিন্তু অনাকাংখিত ভাবে তাঁদের শেষ জীবন কেটেছে। আমাদের প্রবীনগন শেষ বয়সে কত অসহায় আর অনিরাপদ থাকেন তারই স্বাক্ষী বহন করে এই ঘটনা দুটি। আমাদের বাড়ির মধ্য বয়সী কেউ যদি বিয়ের কথা বলেন তাহলে আমরা প্রথমত যে কথা বলি তাহলো " বুড়া বয়সে ভিমরতি"। শুধু কি তাই! নানান সামাজিক বাধা বিপত্তি! মনে ঠাঁই দিন তো কয়েকটি বাস্তবতা যে লোক আপনাকে আদর করেছেন, শাসন করেছেন বড় করেছেন, মানুষের মতো মানুষ করার জন্য জীবনপনণ চেষ্টা করে গেছেন। শেষ বয়সে বিধবা/বিপত্নীক হলে আমরা একবারও ভাবিনা তাদের নিঃসঙ্গতার কথা। শুধু বিয়ে কেন, সারা জীবন যে লোকটি আমাদের ভরন পোষনের দায়িত্ব নিয়েছেন, আগলে রেখেছেন আমাদের, তাঁদের জীবনের পড়ন্ত বেলার অসহায়ত্ব নিয়ে আমরা খুব কমই ভাবি!
সার্ক স্কলার, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ, খ্যাতিমান সাংবাদিক ড. দেওয়ান রাশীদুল হাসান এঁর এক গবেষণাধর্মী লেখা থেকে পাই, আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণদের সংখ্যা হবে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি প্রবীণ জনগোষ্ঠী হব। প্রবীণ জনগোষ্ঠির জন্য সরকারের কিছু কার্যক্রম রয়েছে। সবচেয়ে বড় কার্যক্রমটি হচ্ছে বয়স্ক ভাতা, যার আওতায় সাড়ে ৩১ লাখ প্রবীণকে মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেয়া হচ্ছে। বেসরকারী পর্যায়ে অল্প কিছু বৃদ্ধনিবাস ছাড়া আর কোন কর্মসূচী নজরে আসেনা। আমাদের প্রবীণ জনগোষ্টীর জন্য সরকারী বেসরকারী উদ্যোগ জরুরী। তাঁদের জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহন করা যেতে পারে-
১। আর্থিক ক্ষমতায়ন।
২। বয়স্ক ভাতার পাশাপাশি পেনশন চালু করা।
৩। বয়স্কদের জন্য আলাদা পরিদফতর/অধিদফতর চালু করা।
৪।স্বাস্থ্যসেবায় প্রবীণদের অন্তর্ভূক্ত করে বিশেষ স্কিম প্রণয়ন।
৫।প্রবীণদের জন্য সার্বক্ষনিক খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
৬। সমবয়সী, সমমনাদের সাথে মেশার সুযোগ করে দেয়া।
৭। শহর গ্রাম যেখানেই বাড়ি তৈরী হোক যাদের বৃদ্ধ মা-বাবা আছেন নতুন বাড়ীর ক্ষেত্রে বিষয়টি দেখে যেন বাড়ি অনুমোদন দেয়া হয়।
৮। বয়স্করা যেন নিঃসঙ্গ বোধ না করেন তার ব্যবস্থা করা।
তবে সকল কিছুর আগে আমাদের নিজেদের মনমানসিকতার পরিবর্তন জরুরী। সময় এসেছে দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনের। তাহলেই শেষ বয়সে ভালো থাকবেন আমাদের সাহেদ সাহেব, হরমুজ মেম্বারগন। প্রয়োজন প্রবীণদের সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবনার।
ভালো থাকুন আমাদের প্রবীণরা।