কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙলার ঐতিহ্য ডোঙা
শাহাদৎ রাজীন সাগরঃ কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে অনেককিছুই, হারিয়েছে গরুর গাড়ি, হারিকেন, হুক্কা,ঢেঁকি, সেঁউতি সহ অপরুপ বাঙলার পুরনো সব ঐতিহ্য। মাথল,পলোই, ঝাঁকাই এর হাতে হারিয়ে গেছে বাঙলার আরেকটি ঐতিহ্য তাল গাছের তৈরি ডোঙা। আদিকালে হাওর বাওর,নদী কিংবা খাল বিলে প্রায়ই দেখা মিলতো ডোঙার, তবে নতুন প্রজন্মের কাছে আজ সেটা অদ্ভুত কিছু একটা হয়ে দাড়িয়েছে। জেলেদের মাছ ধরা অথবা লোক পারাপারের জন্য বহুল ব্যবহৃত “ডোঙা” এখন শুধুই ইতিহাস মাত্র।
তাল গাছের সবার নিচের অংশের সামান্য অংশ কেটে এক বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করা ডোঙার প্রচলন শুরু হয়েছিল বহু বছর আগে। এটি ব্যবহার বেশি ছিল হাওর বা নিচু অঞ্চল গুলোতে, বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি জেলাসহ দক্ষিণ বঙ্গের প্রায় বেশ কয়েকটা অঞ্চলে। তবে এটি ব্যবহার যে বরেন্দ্র অঞ্চল অথবা পার্বত্য অঞ্চলে ছিলনা এমনটা নয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যতম জেলা নওগাঁয় এখনো কোন কোন খালে বিলে ডোঙা দেখা যায়, তবে আগে যেভাবে ডোঙা দ্বারা মানুষ পারাপারের কাজ করা হতো এখন সেটি আর নেই। এখন জেলার মান্দা, নিয়ামতপুর, পোরশা, সাপাহার অঞ্চলের সাঁওতাল পল্লীর কেউ কেউ তাদের অন্যতম প্রিয় খাবার শামুক তোলার কাজে ডোঙা ব্যবহার করে থাকে। অনেকটা নৌকার মত দেখতে ডোঙা দ্বারা দিঘিতে মাছের খাবার ছিটানো, নিচু জমির ধান কাটার কাজেও ব্যবহার হয়ে আসছে। হয়তো কালের বিবর্তনে আরও কিছু বছর পর বিলীন হয়ে যাবে বাঙলার এই ঐতিহ্য।
এই জেলার মান্দা উপজেলার মজিবুর রহমান (মজি) নামে ৭০ এর অধিক বয়সের এক বৃদ্ধের সাথে কথা হলে তিনি এবিষয়ে বলেন, এক সময় আমাদের প্রায় প্রতি ঘরে ঘরেই ডোঙা ছিল। এখনকার মত আগে তো কোন রাস্তা ঘাট ছিলনা, বর্ষা আসলে চারিদিকে পানি, বাজার সদা করতে অনেক সমস্যা হতো আমাদের। এক সপ্তাহ পর পর আমরা হাটে যেতাম তরিতরকারি বা অন্য সব বাজার করতে। কারো কারো ডিঙি নাও ছিল। কিন্তু তখন তো তাল গাছ বিক্রিই হতো না, তখন তাল গাছ দিয়ে ডোঙায় বানানো হতো। এখন আর আগের মত ডোঙা দেখা যায় না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন রাস্তা হয়েছে, আর আগের মত মানুষ এখন আর কষ্টও করেনা। আমরা আগে ৭ কোশ বা ৮ কোশ হেটে যেতাম হাটে। গ্রামের সবাই মিলে একসাথে হাঁটা শুরু করতাম।এখনকার লোকজন তো ১০ ধাপই হাটতে চায়না। আগের মত আর পানিও নাই। খাল আছে কিন্তু মাটি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। পানি না থাকলে ডোঙা চালাবেন কোথায়? ডোঙা সত্যিই একটি সহজলভ্য এবং আরাম দায়ক বাহন এমনটাও জানান ওই বৃদ্ধ।
জেলার সদর উপজেলার হাসাইগাড়ি এলাকার মহিবুল্লা নামে প্রায় ৭৫ বছর বয়সের এক বৃদ্ধ এবিষয়ে জানান, আমরা ছোট থেকেই নৌকা এবং ডোঙার ব্যবহার করে আসছি। এখন আর তেমন ডোঙা নেই। একসময় কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে নৌকা অথবা ডোঙায় করে নওগাঁয় নিতে হতো। এখন রাস্তা হয়েছে কিন্তু তবুও আমাদের নৌকার ব্যবহার বন্ধ হয়নি। শীতকালে পুরো মাঠ শুখনো থাকলেও বর্ষাকাল আসলেই আমাদের বাহন নৌকা অথবা ডোঙা। বাবার হাতে তৈরি প্রায় নব্বই বছরের পুরনো ভাঙাচুরা একটি ডোঙাও দেখালেন তিনি,বর্তমান প্রজন্ম ডোঙা নামের কিছু ছিল এটাই হয়তো জানেনা। প্রাচীন এই বাহনটি জাদুঘরে সংরক্ষিত করার দাবীও জানান তিনি।
গ্রীষ্মের চাঁদনি রাতে ডোঙা নিয়ে বিলের মাঝে ঘুরে বেড়ানোর মজাটা হয়তো আর কখনো ফিরে আসবেনা। ডোঙায় চড়ে সকালের ফোটা শাপলা ফুল তুলতে যাওয়া মানুষ গুলোও হয়তো সময়ের ব্যবধান আর জন্ম মৃত্যুর চিরায়ত নিয়মে বিলীন হয়ে গেছে, পৃথিবীর সব আয়োজন, সব কোলাহল বন্ধ করে ফিরে গেছেন ডোঙা তৈরির কারিগররা। তবুও হাজার হাজার বছর ধরে টিকে থাকুক বাঙলার ঐতিহ্যগুলো। আগামী প্রজন্ম জানুক, ঢেঁকি, সেঁউতি অথবা ডোঙা কি জিনিস।