মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার, যেভাবে আপনার অভিষেকে আশ্চর্য হয়েছিলাম সেভাবেই হঠাৎ নির্বাচন স্থগিত করে আপনি হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো সরকার বিরোধী একজনের প্রস্তাবনায় আপনাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব দেয়া হবে এটা ভাবা যতটা কঠিন ছিল ঠিক ততটাই অবাক করলেন আলোচনার বাইরে থাকা একটি আসনে নির্বাচন বন্ধ করে।
সিইসি হিসেবে আপনার নাম ঘোষণার পর যতটা অবাক হয়েছিলাম ততটা অবাক হয়েছি হঠাৎ করে নির্বাচন স্থগিত করার পরও। সকাল থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে নজর রাখছিলাম। না, নির্বাচনের উচ্ছাস নিয়ে নয়। সংবাদে নজর রাখতে গিয়ে। ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা, সোসাল মিডিয়া ঘুরে নির্বাচন নিয়ে কোনো হাঁকডাক পাই নি। কোন প্রার্থীকে হুংকার দিয়ে বলতে শুনিনি, "নির্বাচনে অনিয়ম হলে কড়া ভাষায় জবাব দেবো।"
আপনি হঠাৎ গর্জে উঠলেন। আপনার হুংকারের পরই নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমে, সোসাল মিডিয়ায় আলোচনা শুরু হয়। দেশের একটি সংসদীয় আসনে নির্বাচন হচ্ছে এটা বোধহয় আপনিই মনে করিয়ে দিলেন।
জানি না স্থগিত নির্বাচনে কত টাকা খরচ করেছেন আপনারা। এই নির্বাচন বানচাল হওয়ায় দেশের কত টাকা জলে গেল, সেটা আপনারা জানান নি। অন্তত গণমাধ্যমে এই খবরটি পাই নি। এতে জাতির সময় ও অর্থ অপচয় হয়েছে এতটুকু বুঝতে পারছি। আপনি বিশেষ ক্ষমতায় জাতির সময় ও টাকা নষ্ট করেছেন। এইটা আপনার অপরাধ হয়েছে, নাকি আপনাকে আমরা সাধুবাদ জানাবো সেটাই ভাবছি।
সারাদেশের মাত্র একটি আসনে নির্বাচন করার জন্য আপনাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন এবং সাংবিধানিক অধিকার দেয়া হয়েছিল। প্রথম দুটির যেকোনো একটি সঠিকভাবে কাজ করলে নির্বাচন বন্ধ করতে হতো না। আমরা কি ধরে নেব, এই দুটি অস্ত্র চালাতে ব্যর্থ বলেই আপনি আপনার বিশেষ ক্ষমতাটি ব্যবহার করেছেন?
অভিষেকের পর জাতীয় নির্বাচনসহ আপনার সব মিলিয়ে ৩ টি কঠিন পরীক্ষা। প্রথমটায় (কুমিল্লা) আপনার অবস্থান বিতর্কিত। বিরোধীপক্ষের অভিযোগ ছিল আপনার অধীনস্থ কর্মকর্তারাই ইভিএম -এর ভোট ম্যানুপুলেট করেছে। পরাজিত প্রার্থীর অভিযোগ অনুযায়ী আপনি ফেইল। তারমানে প্রথম পরীক্ষায় আপনি অকৃতকার্য। আপনার নেতৃত্বে সম্পন্ন হওয়া সেই নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের মধ্যে তৈরি হওয়া বিতর্ক মুছে ফেলতেই কি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মোটা অংকের টাকা খরচ করে আপনার সদিচ্ছার কথা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন? নাকি আসলেই সুষ্ঠু নির্বাচন করার বাসনা রাখেন। আপনাকে কি আমরা সেভাবে চিনব, যেভাবে আপনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে ব্যক্তিত্বের সাথে কাজ করেছেন? নাকি হুদা-বেহুদাদেরই একজন আপনি।
আজ কোন এক সাংবাদিক আপনাকে প্রশ্ন করেছিল, একটি আসনেই সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারলেন না। একই দিনে ৩০০ টি আসনে চরম বৈরী দুই দলের মধ্যে হওয়া আসন্ন নির্বাচনের আয়োজন করার সক্ষমতা কি আপনাদের আছে? (প্রশ্নটা হুবহু এরকম নাও হতে পারে।)
আপনি উত্তরে বলেছিলেন, একটিতে হয়নি বলে যে বাকিগুলোতে হবে না, এটা বলা যায় না।
মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার, আপনার কথা শুনে মনে হল আপনি আত্মবিশ্বাসী। আপনার মন বলছে পারবেন। আপনার সাহস আছে। কিন্তু নির্বাচন অফিসে বসে আপনি ডিসি ও এসপিকে ফোনে কী বলেছিলেন, প্রতিউত্তরে ওপাশ থেকে কী জানানো হয়েছিল? সেটা কিন্তু আমরা জানি না। তারা যদি আপনাকে সহযোগিতা না করে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে জনসম্মুখে কিছু বললেন না কেন? আপনার আদেশ না মানায় তাদেরকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিচ্ছেন না কেন? একজন নারীকে ধর্ষণ করলে যদি সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি নির্ধারণ করা হয় তাহলে যাদের কারণে গণতন্ত্র এইভাবে ধর্ষিত হল তাদের বিরুদ্ধে আপনি নির্বিকার কেন?
জনাব হাবিবুল আউয়াল, ধারাবাহিক কয়েকটি নির্বাচন কমিশনের পর আপনার নেতৃত্বে আসা কমিশন নিয়ে কিছু মানুষ বিতর্ক করলেও অনেকে আশান্বিত হয়েছেন। আপনার ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করে বক্তব্য দিতে অনেক রাজনীতিবিদদের দেখেছি। কিন্তু আজ আপনার পঙ্গুত্ব দেখলাম। আপনার এক হাত পুলিশ, অন্যহাত প্রশাসন। কোনটাই কিন্তু আপনার কথা শুনে নি। শুনলে নির্বাচন বন্ধ করলেন কেন?
যে কোন নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা আপনার আছে। কিন্তু সেই ক্ষমতাটা বিশেষ মুহূর্তে প্রয়োগের জন্য। মাত্র একটি আসনেই পুলিশ, প্রশাসন দিয়ে আপনি গণতন্ত্রকে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাতে পারেন নি। বাধ্য হয়ে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়েছে। আপনার দায়িত্বে থাকা গোপন বুথে ওরা উঁকি দিয়ে গণতন্ত্রের লজ্জাস্থান দেখেছে। আপনি একজনকেও গ্রেফতারের আদেশ দিতে পারেননি কিংবা অনুরোধ জানাননি।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ টি আসনে নির্বাচন হবে। বড় দুটি দল যদি অংশগ্রহণ করে তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন পরিচালনার ভয়াবহ দায়িত্ব কিন্তু আপনার কাঁধে। সেখানে কি আপনার দুই হাত তথা পুলিশ ও প্রশাসন আপনার কথা মানবে? প্রতিশ্রুতির বাইরে অন্য কিছু কি দিতে পারবেন?
তারা মানবে না বলে আমরা ধরে নিচ্ছি। আপনি সচ্ছ মানুষ। দুই হাত অকেজো হবার পর আপনি বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে নির্বাচনটা বন্ধ করে দিলেন। তখন কি হবে? তখন ওরা গণতন্ত্রের লজ্জাস্থানে উঁকি মারবেনা। ওরা আপনার দিকে বন্দুকের গুলি ছুড়বে। দুই হাত আগেই হারিয়েছেন। গুলিটা যদি মুখে করে তাহলে মৌখিকভাবে বিশেষ ক্ষমতাও প্রয়োগ করতে পারবেন না। আপনার কি আদৌ কিছু করার আছে? নাকি আপনি করতেই চান না।
লেখক, সুফিয়ান ফারাবী (গণমাধ্যমকর্মী)
সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]01980824081