মানবিক আচরণ দেখার অপেক্ষায় অনার্স মাস্টার্স ৫৫০০ কলেজ শিক্ষক!
আশরাফুল আলম, গাইবান্ধা প্রতিনিধি ঃ
শিক্ষা আর শিক্ষক দুটি শব্দ একটি অন্যটির সাথে সংশ্লিষ্ট। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই হলো শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হল সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। পারিবারিক অর্থে যেকোন সম্পর্কের ভিত্তিতে সকল ধরনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, প্রকৃতির সকল রহস্যমূলক উদঘাটনপ্রসুত অভিজ্ঞতা, সামাজিক রীতিনীতি ও আচার—অনুষ্ঠানে প্রত্যাশিত ইতিবাচক আচরণধারাই হচ্ছে শিক্ষা। মানুষ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শিখে। জীবন ও শিক্ষা তাই সমান্তরাল রেখায় চলে। সুতরাং বলা যায়, শিক্ষাই জীবন ও জীবনই শিক্ষা। কিন্তু শিক্ষার গুরুত্ব জীবনের সাথে সম্পর্কিত হলেও যারা শিক্ষাদানে শিক্ষাগুরুর দায়িত্বে অবতীর্ণ তাদের অধিকার ও মর্যাদা কেন আজ গুরুত্বহীন বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক।
মানব জীবনের সাথে শিক্ষার যোগসূত্র অবিচ্ছিন্ন। শিক্ষাকে আলাদা রেখে মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব, এনিয়ে কারো কোন দ্বিমত থাকার কথা নয়। এবার আলোচনা করা যাক মানুষ গড়ার কারিগর অনার্স মাস্টার্স পাঠদানের দায়িত্বে থাকা ৫৫০০ শিক্ষকদের মানবিক বিপর্যয়ের কথা। বিগত প্রায় বছর খানে আগে থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের অনার্স—মাস্টার্স পাঠদানের দায়িত্বে থাকা প্রায় ৫৫০০ হাজার শিক্ষকের চলমান আন্দোলনের কথা অনেক আলোচিত। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তেমন কোন অগ্রগতি চোখে পরার মতো নয়। প্রায় মাস খানেক হলো সর্বশেষ আন্দোলনের সময়ে শিক্ষামন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় জাতিয় বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি’র আশ^াসে আন্দোলন স্থগিত ঘোষনা করে সিন্ধান্ত জানার অপেক্ষা করছেন এই সকল হতভাগা শিক্ষকমন্ডলী। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে থেকেও দেশের নাগরিক হিসেবে মুখটা ছোট হয়ে যায় যখন দেখি অনার্স—মাস্টার্স কলেজ শিক্ষকদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে রাস্তায় এবং বিশ^বিদ্যালয়ের গেটে প্রখর রৌদ্রের তাপ আর বৃষ্টিতে ভিজে দাবী আদায়ের আন্দোলনে রত। ভাবতেই অবাক লাগে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে থেকেও বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত দেশের সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষক এখনও এমপিওভুক্তির বাইরে রয়েছেন। বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার শর্ত পূরণ করছে এবং উন্নত দেশের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করার আলোচনায় সরগম, ঠিক সেই সময়ে জাতি গঠনের কারিগর শিক্ষকদের ন্যূনতম বেতনের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার বিষয়টি একেবারেই বেমানান।
বর্তমানে যারা চাকুরি অথবা রাজনীতির সুবাদে দেশ পরিচালনার বড় বড় পদমর্যাদায় ভুষিত। যারা জনকল্যানের দায়িত্বে নিয়োজিত আছি তারাও কি কখনো এইসব গ্রামবাংলার শিক্ষকের পরিবার কথা ভেবেছি। কিভাবে মিটে তাদের দৈনন্দিন খাবারের চাহিদা। কিভাবে পরিচালিত হয় তাদের জীবন ও জীবিকা। অথচ বড় বড় শিক্ষিত কর্মকর্তাগণ কোন না কোন শিক্ষকের দ্বারা শিক্ষা জীবন লাভ করে জনকল্যানে নিয়োজিত। এই আধুনিক সময়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশে একজন শিক্ষকের মাসিক বেতন ভাতা বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী মাসিক খরচের কাছে পরাজিত। প্রায় ২৯ বছর ধরে বেতন বৈষম্যের শিকার হয়ে দেশের প্রায় ৪০৪ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৫৫০০ হাজার শিক্ষক প্রায় দীর্ঘ ১০ বছর ধরে রাস্তায় আন্দোলনরত। ধরেই নিলাম যখন তাদের নিয়োগ দেয়া হলো তাদের বেতন ভাতা হবে স্ব—ব্যবস্থাপনায় এমন শর্ত প্রযোজ্য। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে তো কতো কিছুই ঘটে যাচ্ছে। শিক্ষক এবং শিক্ষক পরিবারের জন্য একটু ইতিবাচক চিন্তা করলে তেমন ক্ষতি তো হবে না। চরম সত্য হলো একজন অভিভাবক একটি চাকুরি করেন তার পরিবারের সদস্যদের নূন্যতম প্রত্যাশার বিপরীতে। প্রতিনিয়ত বাজারের বাড়তি চাপ নিয়ে জীবন পরিচালনা করতে হচ্ছে এই শিক্ষকদের। অন্য দশজন শিক্ষকের মতো জীবন যাপন করতে ইচ্ছে করলেও যেন নিরুপায়।
কথা বলছি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালনার শর্তে ১৯৯৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কতৃর্ক বেসরকারি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স শিক্ষা কর্মসূচি চালু করার অনুমতি প্রদানের কথা। জানা গেছে, নিজস্ব প্রতিষ্ঠান কতৃর্ক অর্থায়নে পরিচালনার মধ্যে শিক্ষকদের বেতন কলেজ থেকে প্রদান করার শর্ত রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক বলেন, কলেজে প্রভাষক হিসেবে জাতীয় বেতন স্কেলের নবম গ্রেডে যোগদান করানো হয়। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রামে নিয়োজিত শিক্ষকদের উক্ত স্কেলে বেতন প্রদান না করে তার চেয়ে অনেক কম হারে বেতন প্রদান করা হয়। আবার অনেক কলেজ সেটাও না দিয়ে তালবাহানা করে। আমরা এমপিও ভুক্তির আশায় অন্য কোন পেশায় যেতে পরিনি দীর্ঘ সময়। এমন বয়সে এসে কি করে পরিবারের ভরোণপোষণ মিটাবো বুঝতে পারছি না। অতিরিক্ত চাপে পরলে আত্বহত্যার পথ বেঁছে নিতে বাধ্য হতে হবে হয়তো। পিতা—মাতা হয়ে সন্তানদের নূন্যতম চাহিদা মেটাতে পারি না, কিভাবে অভিভাবকের দাবি নিয়ে সন্তানদের সামনে দাঁড়াবো। সন্তানরা ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে মানুষের মত মানুষ হতে না পারলে এমন জীবন রেখে মানবেতর জীবন যাপনের চেয়ে একবারে মৃত্যুই ভালো।
ভবিষ্যতে এমপিওভুক্তির আশায় প্রায় ২৯ বছর যাবৎ প্রাপ্যতার চেয়ে কম বেতনে বা বেতন ছাড়া শিক্ষাদান করছেন শিক্ষকরা। তারা জানেন না এই অবস্থার ভবিষ্যৎ কি। বর্তমান দ্রব্যমুল্যের কাছে হার মেনে রাস্তায় দাড়ানো ছাড়া তাদের সামনে কোন উপায় নেই। অনেক শিক্ষক ইতোমধ্যেই সরকারি অন্যান্য চাকুরির বয়স সীমা হারিয়ে নিরুপায় হয়ে বসে রয়েছেন এমপিও ভুক্তির আশায়। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি অর্জন করা একজন নাগরিকের মানবিকতা ও মানবাধিকারের বিষয় চিন্তা করেই ইতিবাচক সিন্ধান্ত নেয়া যেতেই পারে। বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের মাধ্যমে শিক্ষা সেক্টরের অনেক বৈষম্য কমেছে। কিন্ত অনার্স মাস্টাস শিক্ষকদের বিষয়ে এখনও কেন এমন বৈষম্য। যদি শিক্ষার্থীদের প্রদেয় অর্থ থেকেই এই ব্যায় মিটানো সম্ভব হয় তবে এই বৈষম্য নিরসন সম্ভব নয় কেন।
দৈনিক শিক্ষা ডটকমের একটি লেখা থেকে জানা গেছে, ২০২০ সালের প্রদত্ত বেনবেইসের তথ্য মতে, বেসরকারি কলেজের অনার্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রামে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২৪৩১৩৮ জন। কলেজভেদে শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন গড়ে ৬০০ টাকা করে ১২ লাখ শিক্ষার্থীর এক বছরের বেতন আসে ৮৬৪ কোটি টাকা। ৫৫০০ জন শিক্ষকের মধ্য থেকে দেড় হাজার জনকে সহকারী অধ্যাপকের স্কেল এবং অবশিষ্ট চার হাজার জনকে যদি প্রভাষকের স্কেলে বেতন হিসাব করা হয়, তাহলে ৫৫০০ শিক্ষকের এক মাসের বেতন হবে ১৪ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার। এই হিসাবে এক বছরের মুল বেতন এবং দুই ঈদে দুটি বোনাস এবং বৈশাখী ভাতার জন্য প্রয়োজন হবে ২০১ কোটি টাকা, যা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংগৃহীত বেতনের ২৫ শতাংশের বেশি নয়। সুতরাং একটি সুপরিকল্পিত নীতিমালা এবং আন্তরিক প্রচেষ্টায় শিক্ষকদের অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে মানবিক আচরণ দেখালে আপাতত তেমন কোনো ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী গত চার বছরে বেসরকারি কলেজে অনার্স মাস্টার্স কোর্স বিষয়ে অনেক বার কথা বলেছেন। তিনি বার বার শুধু স্বপ্নই দেখিয়েছেন কিন্তু দুঃখের বিষয় গত ১৫ বছরে এর বাস্তব রুপ দিতে ব্যার্থ হয়েছেন দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টরা। তারা একাধিক বার শান্তনা দিয়ে শিক্ষকদের চাকুরি হারানোর ভয়ের ক্ষেত্রেই শুধু নিশ্চয়তা দিয়েছেন। শিক্ষকদের বেতন ভাতা সুনিশ্চিত করে মানসিক প্রশান্তির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের মাঝে সুষ্ঠু পাঠদান নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিশ্চয়ই কতৃর্পক্ষ সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য ব্যয় কমিয়ে অন্তত শিক্ষকদের বেতন ভাতার ক্ষেত্রে মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে মানবিক আচরন দেখাবেন এটাই সকলের প্রত্যাশা।