আজকাল নিদ্রাকে খুঁজে পেতে হয়। খুঁজতে খুঁজতে কখনো বিছানায়, কখনো কম্পিউটারের চেয়ারে, আবার কখনো সোফায় গিয়ে সে চোখে মেলে। তারপর এক ঘোর অন্ধকার দিয়ে যাত্রা। এই অন্ধকারে চলতে চলতে চোখে আলো এসে ঠেকলে যাত্রা ভঙ্গ হয়। মৃদু ভাবে চোখ খুলে সে আলোকে সম্ভাষণ জানাবার ইচ্ছা না থাকলেও পরাজিত হয় চোখের পাতা, শরীরের আয়েস-খায়েশ আর জন্ম নেয় দৈনিক ব্যস্ততা।
গতকাল শরীর সোফাতে নিদ্রা খুঁজে পেয়েছিল। তাই লিভিং রুমের ব্যাল্কনি খুব সহজেই রৌদ্রকে আমার চোখের পথ দেখিয়ে সাহায্য করেছিল। চোখ খুলতেই, বারান্দার দরজা বরাবর বসে আছে এক অচেনা ছোট্ট শিশু। কখনো দেখিনি। কিন্তু রৌদ্রের সকল উজ্জ্বলতা সে একাই নিয়ে বসে মোবাইলে বিস্ময়ের সাথে কার্টুন দেখছে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের অবস্থানে অসতর্ক হয়ে উঠছি। কেনটা ঠিক তখনও জানি না। আমাদের বাড়িতে এমন শিশু আকারের কেউ তো থাকে না। চোখ খুলতেই এমন দৃশ্য দেখলে- ভূত, ভবিষ্যৎ, অতীত, সময়, কাল, মহাজগতের বড় বড় তত্ত্ব মগজের ভেতর অঙ্ক কষতে অস্থির হয়ে পরে। তখনই হুট করে ঘর মুছতে মুছতে এক মহিলা পাশ কেটে যাচ্ছে। অঙ্কের হিসেব মিলে গেল। ঘরে নতুন কাজের লোকের আগমনে তার সাথে এই শিশুর আবির্ভাব হয়েছে। মা কাজ করে চলেছে, শিশু কোন এক উপায়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। মা চোখের আড়াল হলেই কার্টুন থেকে মনোযোগ ভেঙে- মা মা করে সারা ঘর খুঁজে বেরাচ্ছে। এক হাজার স্কয়ারফিটের এই ঘরেও মাকে হারাবার ভয় যেমন তার, আমারও কোন অংশে কম নয়।
মা কাজ করছে আর শিশুটি নিজেকে ব্যস্ত রাখবার যে প্রক্রিয়া আজ এই ঘরে চলছে, তা আমার কাছে মোটেও নতুন নয়। শৈশবে মা’র আঙ্গুল ধরে তার অফিস যেতাম। বসে বসে মা সারাদিন কাজ করতো। একটার পর একটা ফাইল নিয়ে তাকিয়ে থেকে কি জানি দেখত আর তারপর লিখত। শেষ হলেই আরেকটা ফাইল খুলে আবার একইভাবে চলতে থাকতো- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি দপ্তরের চাকা। আমার খেলার সাথী তখন পেপার ওয়েট, ইকোনো ডিএক্স কলম, সেই কলমের কালি মুছবার ইরেজার এবং মা এর অফিস সহকর্মীরা। কখনো কলম চুষে মুখে গায়ে কালি মাখিয়ে ফেলা, পেপার ওয়েট ভেঙে বিব্রত করা, আর অদ্ভুত সেই ইরেজার- যা কখনই কোন কলমের কালি মুছতে না পেরে শুধুমাত্র কাগজটিকে ক্ষয় করা; এভাবে আমার কাটতো- জাতীয় নয়টা থেকে পাঁচটা। তার মাঝে মা’র অফিস সহকর্মীরা আমাকে বিরক্তির মাঝেও বেশ আদর করতো। তাদের টেবিলে গিয়ে তাদের খোঁজ নেয়া এবং তাদের টেবিলে রাখা বিভিন্ন বস্তুগুলো কি এবং কিভাবে তাদের সাহায্য করে এবং একই সাথে কিভাবে আমি সেগুলো বাজেয়াপ্ত করবো- তার পায়তারা কোনভাবেই নিস্তার কিভাবে পায়। পুরো বিটিসিএল-এর অফিস তখন আমাকে চিনে। প্রতিটা কক্ষের কর্মচারীরা। আমার সাথে মিশে ছিল তাদের বিনোদন আর বিরক্তি। এই বিরক্তি আর বিনোদন হওয়া থেকে রেহাই পেতে কখনো কখনো একা একা হাঁটতে হাঁটতে এদিক ওদিক চলে যেতাম। আবার মা কাজ ফেলে আমাকে খুঁজে পেলে ধরে নিয়ে ফিরে যেত সেই দপ্তরের কামরায়। সেখানে সবাই আমাকে দেখে মজা মজা মুখ করে বসে আছে। আর আমি বকা খাবো সেই ভয়ে “আপাতত কিছু করবো না” মোডে একটিভ থাকছি।
এই নস্টালজিয়া এবার ভাঙল শিশুটি। “মা কই?”
আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। ঘুম থেকে উঠেই সাথে সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না।
সোফা থেকে শরীরটা উঠিয়ে হেঁটে হেঁটে তার মা-কে খুঁজছি। সে পিছনে পিছনে হাঁটছে। তার মা কে দেখিয়ে দেবার পর দেখলাম, মা-কে পাবার তার খুব একটা ব্যস্ততা নেই। মা যে আছে এটাই তার জন্য জরুরি ছিল। ফিরে আবার সেই দরজার পাশে বসে কার্টুন দেখা শুরু করে দিলো। মুখটা ঘুরিয়ে আমার দিকে একটু হাসিমুখ করল। মনে হল তার মা এর খোঁজ দিতে পারে এমন সবাইকে সে এই হাসিটা উপহার দেয়।
সারাদিন বাইরে নানা কাজ, ফুর্তি করে এসে মা এর সাথে কথা বলার ব্যস্ততা অনুভব করি না। রাতে ফিরে দেখি সারাদিনের ক্লান্তি মুখে মেখে ঘুমিয়ে রয়েছে সে। ক্লান্তি মানুষের ঘুমের মুখকে বিশ্রী করে দেয়। মা- কেও ক্লান্তি মাখা মুখে শৈশবের সেই ফেরেশতা মনে হয় না। কিন্তু মা’র ক্লান্তির কোন বিরাম নেই। মা’দের ক্লান্তির কোন বিরাম নেই। মা-কে পাওয়াটা কোন জরুরি কিছু নয়। মা’র উপস্থিতিটা জরুরি। মা-কে থাকতে হবে, এটাই সবচেয়ে জরুরি।