পরিবারে কোনটা বেশি প্রয়োজন ভালবাসা না কি বন্ধুত্ব!
আশরাফুল আলম, গাইবান্ধা প্রতিনিধি
মানুষ সামাজিক জীব। মানুষকে সমাজ এবং পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। পরিবার এবং সমাজ ছাড়া মানুষের বসবাস কল্পনা করা যায় না। আপনি আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী জম্মগ্রহণ করেন নি। আপনার ইচ্ছা মত চাইলে যেকোন সময় মরে যেতেও পারবেন না। জম্ম এবং মৃত্যু হয় সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সময়ে এবং তা অবশ্যই আমাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে নয়। আমরা জম্ম এবং মৃত্যু পর্যন্ত মাঝের সময় টুকু আমাদের নিজেদের প্রয়োজন আর ইচ্ছানুয়ায়ী অতিবাহিত করার চেষ্টা করি যদিও ভাগ্য এবং অন্যান্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে জীবনের বেশিরভাগ সময় চলে যায়। আমরা নিজেরাই অনেক সময় উপলগ্ধি করি, জীবন অতি ক্ষুদ্র সময়ের সমষ্টি। কারণ সময় অনেক অল্প কিন্তু আমাদেরকে অনেক বিশাল বিশাল কর্ম সম্পাদন করে বেঁচে থাকতে হয়। এই কর্ম সম্পাদনের অন্যতম প্ল্যাটফর্ম হলো পরিবার। প্রতিটি পরিবারে একাধিক মানুষ জম্মগ্রহণ করে। পরিবার হলো মানুষের বেড়ে ওঠার আদর্শ বিদ্যালয়, আর সেই বিদ্যালয়ের আদর্শ শিক্ষক হলেন বাবা মা এবং অন্যান্য গুরুজন। আমরা নিজেদেরকে অনেক ভাবেই নানা কাজের মধ্যে পরিবারের স্মৃতি করে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। তাঁর মধ্যে অন্যতম হলো বন্ধুত্ব, ভালবাসা আদান-প্রদান এবং সাথে কিছু উদ্যোগ। বন্ধুত্ব এবং ভালবাসার মধ্যেই পরিবারের মানুষ গুলো একে অপরের নিকট তাদের প্রিয়জনকে খুঁজে পায়। যুগ যুগ ধরে প্রিয় মানুষের স্মৃতি আঁকরে ধরে জীবন কাটাতেও দ্বিধা করে না। প্রিয়জনের প্রতি প্রকৃত ভালবাসা কখনো নষ্ট হয় না। তবে বন্ধুত্ব এবং ভালবাসা কিভাবে টিকে থাকে তা পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যদেরকে আন্তরিক ও গভীর বিশ্লেষণ করতে হবে।
একটি পরিবারে স্বামী-স্ত্রী কিংবা দায়িত্বশীল দুজন মানুষকে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য সমান ভুমিকা পালন করতে হয়। কারণ দায়িত্বহীন প্রচন্ড ভালবাসাটাও ছন্নছাড়া হয়ে যায়। ভালবাসা খুব সুন্দর, কারণ এটা হৃদয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আর বন্ধুত্ব আরো বেশি সুন্দর কারণ এটা হৃদয়কেই নিয়ন্ত্রিত করে। একটির সাথে অন্যটি এতো নিবিরভাবে সংশ্লিষ্ট যে দুটির মধ্যে ভাগ করার সুযোগ নেই।
ভালবাসা এমন এক তীব্র অনুভুতি যা দুটি মনের ইচ্ছা আর আকাঙখাকে এক সুুঁতোয় বেঁধে ফেলে। রুপ, রস, গন্ধবিহীন এই আবেগকে সঙ্গে নিয়ে মানুষ একসঙ্গে পথচলার স্বপ্ন দেখে অথবা দীর্ঘ পথচলার শপথ গ্রহণ করে। ভালো লাগার এক স্পর্শকাতর অনুভুতির নাম ভালবাসা। এই ভালবাসার কথা অথবা ধারনা শুধু মাত্র কয়েকটি সম্পর্কের সীমানায় বেঁধে দিয়ে এর প্রকৃত মর্মার্থ অপ্রকাশিত রাখলে চলবে না। ভ্রান্ত ধারনার মতবাদ থাকলে তার পক্ষে প্রকৃত ভালবাসা বুঝতে পারা সম্ভব নয়। কারণ ভালবাসা শুধু ছোট্র আক্ষরিক অর্থে প্রেমিক যুগলের মাঝে অনুভুতি যোগায় না। এর পরিধি সারা পৃথিবী জুরে সকল প্রাণীকূলের সম্পর্কের মাঝে বিদ্যমান যা পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিস্তৃত। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে আমরা চিরন্তন বলে জানি। ধর্মীয় বিধি বিধান মেনে সময়ের সাথে সাথে যাকে নিয়ে সারা জীবন কাটানোর শপথ নেয় হয়, যার জন্য দিনের পর দিন হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করে নিজের চাওয়া পাওয়াকে বিসর্জন দেয় সেই মানুষটি কিসে খুশি থাকে অথবা কতটুকু তার চাওয়া তা না বুঝেই কেউ কেউ দায়িত্ব পালনের ব্যার্থ চেষ্টা করি। কথা এমন যে, আমরা আজকাল আর সেই ভালবাসাকে আদর্শের জায়গাতে প্রকাশ করতে পারি না। শুধু চাওয়া পাওয়ার স্বার্থের দরে ওঠা নামা করে। স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, পিতা-পুুত্র, ভাই-ভাই, বন্ধু-বান্ধবসহ ইত্যাদি সম্পর্ক গুলি কেমন যেন চাওয়া পাওয়ার স্বার্থে পরিচালিত হয়। ইচ্ছে হলেই একে অপরকে ভালবাসার সারথী হতে পারি না। একবার অন্তরের ডাকে সারা দিলে দুইবার পিছিয়ে সম্পদ আর অর্থ লোভ মনকে প্রভাবিত করে। স্বার্থ আর মানসিক দ্বন্দে একটু একটু করে ভালবাসার মানুষ গুলো দুরে সরে গিয়ে ভালবাসা গুটিয়ে নেয় অথবা গুটিয়ে যায়। বুঝতে হবে একজন মানুষ কখনোই সকলের মন জুগিয়ে চলতে পারে না একজন পরিবারের কর্তা যখন নিরন্তর পরিশ্রম করে পরিবারের অন্যান্য সদস্যর জন্য আহার সংগহ করেন। তখন সামান্য অজুহাতে অথবা ভ্রান্তিতে হাজারো প্রচেষ্টার বিপরীতে তার কপালে ব্যর্থতার সার্টিফিকেট ছাড়া কিছুই মিলে না। নিরন্তর পরিশ্রম করা মানুষটি তখন পরিবারের অন্যান্য সদস্যর কাছে কেমন যেন রঙহীন হয়ে ওঠে। যার অন্যতম একটি উদাহারণ ব্যবসায়ী মহসীন খানের ডিপ্রেশন থেকে আত্বহনন (নিজ পিস্তলের গুলিতে আত্বহত্যা করা)। ভালো সময়ে সকল প্রিয়জন কাছে থাকলেও দুর্দিনে তাকে ছেড়ে আলাদা থাকতে কারো কোন কষ্ট হয়নি। কিন্তু মহসীন খাঁন খুঁজে পাননি পরিবারের সদস্য কর্তৃক তাকে ছেড়ে যাবার কারণ। নিজের প্রতি অজস্্র ঘৃণা জমা রেখে কখনই কাউকে ভালবাসা বা ভাল রাখা যায় না। এখানে নিজের প্রতি বিশ্বাস টা খুবই জরুরী। অধিকাংশ মানুষের-ই অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া একেকটা করে কালো অধ্যায় থাকে। সেই অধ্যায় থেকে শিক্ষা নিয়ে অনেকেই জীবনটাকে নতুন করে সাজায়। ফলে সেই সুযোগটি যেন আমরা দিতে ভুলে না যাই।
কথাটা শুধু একজন নারী বা পুরুষের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে প্রযোজ্য তা বলছি না। এমন বাক্য নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই চলে। তাই কোন একজন ব্যক্তি বলেছেন ‘‘শুভ্র, সুন্দর আর শ্বাশত ভালবাসা যুগে যুগে বেঁচে থাকুক মানুষের মাঝে। ভালবাসার রঙে রাঙা হোক পৃথিবী। ভালবাসার শক্তি সঞ্চয়ে জয় হোক সব শুভ চেতনার’’।
কোন একটি লেখায় পড়লাম, একটি বই একশোটি বন্ধুর সমান কিন্তু একজন ভালো বন্ধু পুরো একটি লাইব্রেরীর সমান। বলা হয় বন্ধুত্ব এমন একধরনের সিমেন্ট যা দিয়ে পুরো পৃথিবীকে একত্র জোরা লাগানো সম্ভব। বন্ধুত্বের প্ল্যাটফর্ম সুবিশাল সমুদ্রের মতো বিস্তৃত। বন্ধুত্ব হচ্ছে এক নির্ভরতা যা মনকে আবিস্কার করার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা সম্পন্ন। কারো মন দিয়ে অন্য কাউকে ছুঁয়ে দিয়ে হৃদয়ের বন্ধন গড়ে তোলার নামই হচ্ছে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব এমন এক আবেগ যা কখনো কখনো মানুষকে আতœসমর্পন করতে, নতুনভাবে স্বপ্ন দেখতে শেখায় আরও শেখায় ত্যাগ-তিতিক্ষা ও ধৈয্য। কখনো আবার শ্রদ্ধাভরা মন নিয়ে সামনে গিয়ে দাড়িয়ে অতীতের কথা মনে করিয়ে ভাললাগা অথবা কষ্ট পাওয়ার কথায় নিরবে কাঁদায়। আমাদের মন নানান রঙে রঙিন তাই মনের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ঠিক ঋতু পরিবর্তনের মতই পরিবর্তন হতে পারে। তবে বন্ধুর সম্পর্ক চির তরুণ। আমাদের উচিৎ বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে বাবুই পাখির বাসার মতো শক্ত করে বেঁধে রাখা। আমরা সকলই জীবন যুদ্ধে অংশ নিয়েই বেঁচে আছি, সেই যুদ্ধের মাঝে সামান্য একটু সময় দেহ-মনকে সতেজ করে নিতেই একজন ঘনিষ্ট দুষ্ট মিষ্ট বন্ধুর প্রয়োজন খুব জরুরী সেটা পরিবারে হোক অথবা পরিবারের বাহিরে। এই প্রয়োজন থেকে যে বিচ্যুত সে আমাদের সমাজে নিশ্চয়ই বেমানান। ভালবাসা হয় দুটি মানুষের মধ্যে আর বন্ধুত্ব হয় দুটো সুন্দর মনের মধ্যে। কারণ আপনার প্রকৃত বন্ধু সে, যে আপনার মনের সব কষ্ট বুঝে নেয় ঠিক যখন আপনি সারা পৃথিবীকে বোকা বানিয়ে মনের কষ্ট লুকিয়ে রাখেন নিজের মধ্যে। বন্ধুত্ব শুধু একটা শব্দ নয়, শুধু একটা সম্পর্ক নয়, এটি একটি নিরব প্রতিশ্রতিও বটে। বন্ধ¡ত্বের সীমানা শুধু বাল্যকাল শৈশব কাল আর ছাত্র জীবনের মধ্যেই সীমা বদ্ধ নয় এটি গড়ে উঠতে পারে প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র, ভাই-বোন কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মাঝে। একটি পরিবারের সকল সদস্যদের মধ্যে যেমন শ্রদ্ধা এবং ¯েœহ সুলভ ভালবাসার আদান-প্রদান থাকবে ঠিক সমান ভাবে থাকতে হবে বন্ধু সুলভ আচরণ শেয়ারিং এবং কেয়ারিং।
কারো জন্যে কারো জীবন থেমে থাকে না এটি যেমন সত্য তেমনি দুঃখের নদীতেও কোন মানুষ সারাজীবন সাতার কাটবে এটাও ভাবা ঠিক হবেনা। ঘোলা পানিতে সাতার কাটতে কাটতে ঠিকই একদিন পরিস্কার স্বচ্ছ পানিতে নিজেকে সুখের সাগরে ভাসাবে। কিন্তু সমস্য হলো ভালবাসার সঠিক আদান-প্রদান আমরা সঠিক সময়ে করতে পারি না। আমরা পাহাড় সমান দায়িত্ব পালনকারী ভালবাসার মানুষগুলোকে সঠিকভাবে চিনতে পারি না। হৃদয় দিয়ে তার মনের কথা গুলো বোঝার চেষ্টাও করি না। ফলে অসময়ে মিছে হাহুতাশ করি। যেমনটি করেছিল ঢাকার ধানমন্ডির মহসিন খান। সারাজীবনে পরিবারের জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করেও পরিবারের সদস্যহীন একাকীত্বের বেদনায় নিজ পিস্তল দ্বারা আত্তহননের পথ বেছে নেন। অথচ তার পরিবারের মানুষ গুলো আগে কখনোই জানার চেষ্ট করেনি অথবা গুরুত্ব পায়নি তার কষ্টের কথা। গুরুত্ব না দেওয়ায় হয়তো তার কষ্টের সীমানাটা একাধারে বাড়তে বাড়তে সর্বশেষ প্রান্তে পৌঁছেছিলো। তাই একান্ত কাছের মানুষ গুলোকে না পাওয়ার বেদনা নিয়ে অস্বাভাবিকভাবে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হলো। তাই আমাদেরকে বুঝতে হবে ভালবাসার সঠিক মানে বন্ধুত্বের সঠিক বন্ধন। পরিবারের মানুষ গুলোকে যেন আমরা শুধু টাকা বানানোর মেশিন মনে না করি। দায়িত্বভারে নুয়ে পরা মানুষ গুলোর প্রতি যেন আমাদের আন্তরিকতা আর সঠিক ভালবাসার বন্ধুত্বের বন্ধনে বেঁধে সুখের সাগরে ভাসতে পারি। পরিবারের ছোট বড় সকল সদস্যর মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করা প্রত্যেকের দায়িত্ব। মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আদর্শ ভালবাসা আর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত হোক প্রতিটি পরিবার। কারণ ভালবাসা এবং বন্ধুত্ব দুটোই একটি পরিবার অথবা সম্পর্কের জন্য একে অন্যের পরিপূরক। তাই অদম্য ভালবাসা আর ইতিবাচক বন্ধুত্বপূর্ণ আচরনের মাধ্যমেই পরিচালিত হোক প্রতিটি পরিবার। জয় হোক ভালবাসার জয় হোক বন্ধুত্বের।