Md. Faruk Hossain Apon - (Natore)
প্রকাশ ০৮/০৩/২০২২ ০১:৪৪পি এম

হারিয়ে যাচ্ছে নাটোরের বেত বনঃ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বেত শিল্প

হারিয়ে যাচ্ছে নাটোরের বেত বনঃ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বেত শিল্প
নাটোরের গ্রামে গ্রামে অথবা শহরের আশে পাশের রাস্তার দু'পাশে, পতিত জমি বা জলাশয়ে দেখা মিলত ক্ষুদ্র ও বৃহৎ আকারের বেত বন। যা এখন শুধুই স্মৃতি। অনেক স্মৃতি ছবি বা মুঠোফোনে বন্দী হলেও, বেত এখন এ এলাকার এক বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ। এখন সড়কের দুই পাড়ে চোখে পড়ে কেবল বসতি। ভরাট হচ্ছে জলাশয়, অবরুদ্ধ হচ্ছে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ। বাড়ছে জনসংখ্যা, কমছে বন, জমি, জলাশয়। প্রকৃতি হারাতে বসেছে ভারসাম্য। উজাড় হয়েছে বেত বন, বন্ধ হয়েছে বেত শিল্প, বেতের তৈরি শৌখিনসহ সকল পণ্যের ব্যবহার।

এক সময় সাধারণত নাটোরের বিভিন্ন গ্রামের রাস্তার পাশে, বসতবাড়ির পেছনে, পতিত জমিতে ও বনে কিছুটা আদ্র জায়গায় বেতগাছ দেখা যেত। এটি বড় হয়ে ঘন হয়ে ঝাড়েও পরিণত হত। সপুষ্পক উদ্ভিদ বেত ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলের ভেজা ও জংলা নিচু জমিতে ভাল জন্মে। বেতগাছ জঙ্গলাকীর্ণ কাটাঝোপ আকারে দেখা যায়। চিরসবুজ এই উদ্ভিদটি পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় ৪৫ থেকে ৫৫ ফুট এবং কখনো তার চেয়েও বেশি লম্বা হয়ে থাকে। সাধারণত ছয় প্রজাতির বেত পাওয়া যায়। এদের কান্ড দেখতে চিকন, লম্বা, কাঁটাময় ও খুবই শক্ত এবং শাখাহীন।

বেত গৃহনির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে রেস্তোরা, ঘর বা অফিসের শৌখিন পার্টিশন হিসেবে এর ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। এছাড়া লম্বা বেত ফালা করে নানা কিছু বাধার কাজেও ব্যবহার করা হয়। বেতের প্রধান ব্যবহার হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরির কাঁচামাল হিসেবে। তবে ফল খেতে সুস্বাদু ও অনেকেরই প্রিয়। শুকনো বেত দিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প জাতীয় জিনিসপত্র তৈরি করা হয়, যেমন- চেয়ার, টেবিল, মোড়া, ডালা, কুলা, চাঙ্গারী, মুড়া, হাতপাখা, চালোন, গোলা, ডোল, ধামা, পাতি, বই রাখার তাক, সোফা, দোলনা, খাট, ঝুড়ি, টেবিলল্যাম্প, ল্যাম্পশেড ইত্যাদি।

নাটোরের বলারীপাড়া মহল্লার খন্দকার আনিছুর রহমান জানান, বেশ মনে পড়ে আশির দশকের কথা। তার পিতার প্রায় চার বিঘা জায়গা জুড়ে ছিল প্রকান্ড বাগান। বাগান জুড়ে ছিল বিভিন্ন জংলা গাছ, ফলজ গাছ সহ বাঁশ বন আর বেত বন। বাগান জুড়ে এখন শুধুই নির্মাণ হয়েছে ইমারত। বসতির কারণেই উজাড় হয়েছে বাগানের গাছ গাছালি আর বেত বন।’

বড়াইগ্রাম উপজেলা প্রেসক্লাব সভাপতি অহিদুল হক জানান, এক সময় গ্রামে অনেক বেত বন ছিল। বেতের জালি ডগা দিয়ে তরকারি খেতাম, বেতের ফল খেতাম, বেত দিয়ে বিভিন্ন ধরনের নিত্য ব্যবহারযোগ্য পণ্য তৈরি ও সরবরাহ করতেন অনেকে, যা তাদের আয়ের উৎস ছিল। এখন আর বেত বন নেই। নেই সেই কুটির শিল্প কর্ম। সেইসব দিন এখন শুধুই স্মুতি।

নাটোর শহরের নিচাবাজারের হস্তশিল্প বিপনন প্রতিষ্ঠান নিতাই ষ্টোরের মালিক শ্রী নিতাই বসাক জানান ‘৯০ দশকে তিনি বেতের তৈরি পন্য বিক্রি করতেন। এখন আর পাওয়া যায় না, ক্রেতারাও চায় না। প্লাষ্টিক পণ্যের ভিড়ে হারিয়ে গেছে হস্তশিল্পের অনেক পন্য। আগে প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ বাঁসের, বেতের তৈরি অনেক কিছুই ব্যবহার করতো। এখন বিলাসিতা আর সৌখিনতায় অনেকে এগুলো ব্যবহার করেন।’

বড়াইগ্রাম উপজেলার ঋষিপাড়ার বাসিন্দা নিমাই চন্দ্র জানান, “বাপ-দাদার পেশা ছিল বেতে দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি, বিক্রয় ও মেরামত করা। এতেই খুব ভালভাবে চলতো আমাদের সংসার। আমিও ছোটবেলা থেকে তাদের সাথে এ কাজ করতাম। কিন্তু এখন বেত বন না থাকায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এ শিল্পকর্ম। বিকল্প কর্মের সন্ধান করতে হচ্ছে আমাকে।”

নাটোর জেলা বন কর্মকর্তা সত্যেন্দ্রনাথ জানান, আপাতত সরকারিভাবে বেত বন করার কোন পরিকল্পনা নেই এবং সে জায়গাও নেই। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সরকারিভাবে বেতের আবাদ করা হয়। তার মধ্যে উত্তরবঙ্গের রংপুর, গাইবান্ধা অন্যতম। রাজশাহী জেলার ধামুর হাটের শাল বনের ভিতরে বেতের চাষ করা হয়। নাটোর জেলায় সেই ধরনের বন বা জায়গা নেই। আর ব্যক্তি মালিকানার জায়গায় যে সমস্ত বেত বন ইতি পূর্বে ছিল সেই সমস্ত জায়গায় বসতি গড়ে উঠার কারনে সেগুলো এখন আর দেখা যায় না।

নতুন নতুন বসতবাড়ী, কলখারখানা নির্মাণ, জনসংখ্যার চাপ, বসতি সংকট, নানা প্রকার দূষনের কারণে দিন দিন কমে যাচ্ছে বন, জলাশয়, ফসলি জমি, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রকৃতি। প্রাকৃতিক পরিবেশ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ জেলাকে দূষণ মুক্ত পরিকল্পিত বাসযোগ্য রাখতে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার বলে মনে করছেন নাটোরের সচেতন মহল।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত সংবাদ