Abir Ahmed Hamid - (Rangpur)
প্রকাশ ০৮/০৩/২০২২ ০১:৪৫পি এম

সত্য বললে রাজাকার, মিথ্যা বললে পুরস্কার - ডক্টর তুহিন মালিক

সত্য বললে রাজাকার, মিথ্যা বললে পুরস্কার - ডক্টর তুহিন মালিক
এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকার তার লেখা বইয়ে নতুন কিছু কী লিখেছেন? ৭ মার্চের ভাষণে ‘জিয়ে পাকিস্তান’ শব্দ দুটির কথা। এর আগেও নির্মল সেন ‘আমার জীবনে ৭১-এর যুদ্ধ’ বইতে এটা লিখেছেন। আরেক সেক্টর কমান্ডার কাজী নুরুজ্জামান ‘রিমেমবারস বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার ১৯৭১’ বইতে এটা লিখেছেন। আহমেদ ছফার প্রবন্ধ সংকলন থেকে সলিমুল্লাহ খানের সম্পাদনায় ‘বেহাত বিপ্লব ১৯৭১’ বইতেও এ কথা বলা আছে। অলি আহাদের ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’ বইতে এ কথা আছে। ২০১১ সালের ৭ মার্চ তারিখের এক পত্রিকায় আতাউস সামাদের ‘যেভাবে আমরা পেলাম দিনটি’ শীর্ষক কলামেও একই কথা আছে। বদরুদ্দীন উমরের লেখা ‘আমার জীবন (তৃতীয় খ-)’ বইতে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘বাংলাদেশের তারিখ’ নামের বইয়ের প্রথম সংস্করণে তিনিও তাই লিখেছেন। কবি শামসুর রাহমান নিজেও তার স্মৃতিচারণমূলক বই ‘কালের ধুলোয় লেখা’ বইতে লিখেছেন যে, বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা, জিয়ে পাকিস্তান’ বলে তার বক্তব্য শেষ করেছিলেন।

এই বিতর্ক নতুন কিছু নয়। ‘৯৬-এর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায়ই এ নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ এবং ‘দেয়াল’ গ্রন্থে এই তথ্য সন্নিবেসিত করলে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, একে খন্দকার আওয়ামী সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী থাকাকালীন প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর’ গ্রন্থেও একই তথ্য প্রকাশ করলে তখন কেউ তাকে রাজাকার বা পাকিস্তানের এজেন্ট বলেনি!

আমাদের রাজনৈতিক চরিত্রগুলো সুপারম্যান বা সুপার ভিলেনের। এখানে রক্ত-মাংসের কোনো মানুষের চরিত্র যেন থাকতে নেই। বঙ্গবন্ধু রক্ত-মাংসের একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কোনো সুপারম্যান নন। তিনি ছিলেন একজন রাজনৈতিক নেতা। রাজনৈতিক কলাকৌশল মেনেই তাকে রাজনীতি করতে হয়েছিল।

এ দেশের মুক্তি সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অনস্বীকার্য। নেতৃত্বের ফলেই তিনি মহানায়ক হয়েছিলেন। যারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাণিজ্য করে, বঙ্গবন্ধুর নাম বিক্রি করে সংসার চালায়, তারা বঙ্গবন্ধুর সমালোচনাকে সহ্য করতে পারে না নিজেদের বাণিজ্য ঘাটতির ভয়ে। এই অবিবেচকরাই বঙ্গবন্ধুকে ৭ মার্চের ভাষণে আর মুজিব কোটে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু তার সব সীমাবদ্ধতা নিয়েই ইতিহাসের মহানায়ক হয়েছিলেন। স্বাধীনতা নিয়ে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা কোনোক্রমেই তার অবমাননা হতে পারে না। সমালোচনার অধিকার আমাদের প্রত্যেকের নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার। সমালোচনা করলে বঙ্গবন্ধু কখনো খাটো হওয়ার নন। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর পরিবার কেন সমালোচকদের ঘোর শত্রু মনে করে বঙ্গবন্ধু চরিত্রের মূল উপাদানও তো শাসকদের সমালোচনায় মহিমান্বিত।

মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি এবং যার সম্মুখে হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে সেই বীর সেনানী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকারকে রাজাকার, কুলাঙ্গার বা আইএসআইর এজেন্ট বলা চরম দুঃখজনক ও লজ্জাকর। দেউলিয়া রাজনীতির এ কোন হিংস্র শিকারে পরিণত হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাদের এহেন কাজে মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নবিদ্ধ ও হাস্যকর হয়ে ওঠে। এ দায় কাদের ওপর বর্তাবে এমন প্রশ্ন সবার।

এগুলো নিয়ে সংসদ উত্তপ্ত করে জ্বালাময়ী ভাষণ আর কুলাঙ্গার-রাজাকার আখ্যা দিয়ে মাঠ গরম করা যায় সত্যি। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে মানুষের মনে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগও পাকাপোক্ত করা হয়। জাতীয় জীবনে এটি একটি ভয়ঙ্কর খেলা। কারণ ৭ মার্চের ভাষণ যারা রেডিওতে শুনেছেন বা যারা সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন তাদের অনেকেই এখনো জীবিত আছেন। আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে, এখনো হয়তো সেই ভাষণের টেপ ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বন্ধুপ্রতিম দেশের হাতে রয়েছে। অনর্থক এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়।

এ কেমন নীতি সত্য বললে দেশদ্রোহী রাজাকার! আর মিথ্যা বললে পদ-পদক পুরস্কার! সারা জাতি আজ পদ পুরস্কারের মোহে আবদ্ধ। ক্ষমতা আর অর্থের লোভে সত্য আজ নির্বাসিত। আসলে আমাদের জ্ঞান প্রবেশ করে দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি দিয়ে। আর লোভও কিন্তু সে রকমই চোখ আর কান দিয়েই প্রবেশ করে। কিন্তু আমাদের মন একসঙ্গে দুটোকে মনের মাঝে জায়গা দিতে পারে না। তাই মনের মাঝে লোভ জায়গা দখল করে বসলে তাতে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায় অনায়াসে। এই লোভী রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত করতে হবে আমাদের মহান অর্জনগুলোকে। ইতিহাস নিয়ে বাণিজ্যিক চর্চা না করে আমাদের আগামীর গৌরবময় ইতিহাস রচনার কাজ শুরু করতে হবে। এটিই এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত সংবাদ