Md. Ashraful Alam
প্রকাশ ০৫/০৩/২০২২ ০৮:৪৮পি এম

লাগাম ছেঁড়া দ্রব্যমূল্য অনিশ্চিত নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য!

লাগাম ছেঁড়া দ্রব্যমূল্য অনিশ্চিত নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য!
প্রতিদিন খাবার গ্রহণের সময় আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হই। নিজের মনকে প্রশ্ন বাণে জর্জরিত করি যে আমি অথবা আমরা যা খাচ্ছি তা কি নিরাপদ আর যথাযথ পুষ্টি সমৃদ্ধ? এমন প্রশ্নের উদ্ভব হওয়ার কারণ চোখের সামনে ফল ও সবজিকে দীর্ঘ সময় চকচকে আর সতেজ রাখার যে প্রলেপ মাখা তা অবস্থা দেখলে সহজেই বোঝা যায়। এসব খাবারে নিষিদ্ধ অতি মাত্রায় ক্যামিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে। উপায়ন্তর না ভেবে ঐসব ফল ও শাকসবজি খেয়ে শরীরে নানা রোগের সৃষ্টি করি। সাথে সাথে বাড়িয়ে দেই মৃত্যুর ঝুঁকি। খাদ্যের ফলে শারীরিক ঝুঁকি নিয়ে আমরা সবসময় উদ্বিগ্ন থাকি। প্রতিটি মানুষই তার নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার প্রত্যাশা করে। নিরাপদ খাদ্যের মাধ্যমেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজম্মের বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিযোগিতায় হয়ে উঠবে দক্ষ মানবসম্পদ গুণাগুণ সমৃদ্ধ। কিন্তু সেই নিরাপদ আর পুষ্টিগুণ খাবার আমরা কতটুকু গ্রহণ করতে সামর্থ হচ্ছি সেই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর মেলা দায়।

নিরাপদ খাদ্য বলতে যা বোঝায় তা হলো প্রত্যাশিত ব্যবহার ও উপযোগিতা অনুযায়ী মানুষের জন্য বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত আহর্য হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য। তবে কথা হলো খাদ্য কিভাবে নিরাপদ হয় বা নিরাপদ থাকে তা সকলের জানা আবশ্যক। খাদ্য নিরাপদ হবার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে সেই বৈশিষ্ট্য যদি খাবারের মধ্যে পরিপূর্ণ থাকে অথবা সকল নিয়ম-কানুন মেনে খাদ্য প্রস্তুত করা হয়ে থাকে তবে মনে করতে পারি যে খাদ্যটি নিরাপদ হয়েছে এবং তা স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী। নিরাপদ খাদ্যের যে সকল বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করা জরুরী তা হলো- খাদ্য সরবরাহের জন্য পরিস্কার থালা বাসন ব্যবহার, খাদ্য প্রস্তুতে নিরাপদ পরিস্কার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার, প্রস্তুতকৃত অথবা উৎপাদনকৃত খাবার যতœসহকারে ঢেঁকে রাখা, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার প্রস্তুত করা, কাঁচা এবং রান্না করা খাবার আলাদা পাত্রে রাখা, খাবারে কোন রকম অননুমোদিত রং ব্যবহার না করা, পর্যাপ্ত তাপমাত্রায় খাবার তৈরী করা, প্রাকৃতিক উপায়ে বালাইনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করা, পশু বা মৎস্য চিকিৎসায় ঔষধের ব্যবহারের পর নিদ্দিষ্ট সময়ের পরে খাদ্য সরবরাহ বা গ্রহণ করা ইত্যাদি।

আমাদের দেশের সংস্কৃতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতি মুনাফা লোভীতে পরিণত হয়েছে। সে কারনে অধিক মুনাফা লাভের আশায় নাগরিকের জীবন নিরপত্তার কথা চিন্তা না করেই যত্রতত্রভাবে কারখানা স্থাপন করে অদক্ষ এবং পর্যাপ্ত জ্ঞানহীন কর্মচারি দিয়ে খাদ্য প্রস্তুত করে তা বাজারে ছাড়া হয়। কোন কোন প্রতিষ্ঠানের মালিকের জ্ঞাতেই শুধুমাত্র চকচকে ঝকঝকে দৃশ্যমান করতেই বিভিন্ন অননুমোদিত উপকরণ মিশিয়ে খাদ্যকে নিরাপত্তার পরিবর্তে অনিরাপদ করা হয়। এর ফলে খাদ্য গ্রহণকারী মানুষের জীবনের প্রতি হুমকি হিসেবে নানা ধরনের রোগ বালাই বাসা বাধে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পরিবর্তে কমে যাচ্ছে।

একজন খাদ্য গ্রহণকারী ভোক্তা হিসেবে নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার অধিকার সকলের রয়েছে। কিন্তু অনেক সময় ভোক্তা না জেনে বুঝে বা না দেখেই অনিরাপদ খাদ্য ক্রয় করে এবং ভোগ করে থাকেন। এক্ষেত্রে নাগরিকের দায়িত্ব হচ্ছে যেকোন খাদ্য ক্রয়ের সময় প্যাকেটের গায়ে মেয়াদ উত্তীর্ণের এবং প্রস্তুতের সময় দেখে ক্রয় করতে হবে। খাদ্য ক্রয়ের সময় ক্রয়ের রশিদ গ্রহণ করতে হবে যাতে পরবর্তীতে খাবার অনিরাপদ বলে প্রমাণিত হলে যথাযথ দপ্তরে অভিযোগ করবার সুযোগ থাকে। সেক্ষেত্রে খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত এবং স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে খাদ্য ক্রয় করা উত্তম।

খাদ্য উৎপাদন থেকে খাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ নিরাপদ রাখার দায়িত্ব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তির। কিন্তু তারা কি তাদের সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে? না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই ধরনের কোন উদ্যোগ আমরা দেখি না। কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী জেনে বুঝে লোভের শুধুমাত্র অধিক মনুফার লোভে ভেজাল বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদি বাজারজাত করে থাকে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আমরা না জেনে তাদের উপর অগাধ বিশ^াসে দ্রব্য ক্রয় করি। বিশ^াসের গোড়া কেটে আবার পানি ঢালারও লোকের অভাব নেই। গ্রাহকের চোখের আড়ালে উৎপাদিত খাদ্যকে অনিরাপদ করতে তাদের কোন রকম অনুশোচনাও হয় না। প্রতিষ্ঠানের মালিক থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত ম্যানেজার বা যেকোনো পদের কর্মকর্তা এবং তৃণমুলের খুচরা বিক্রেতাও সেই সুযোগ নিয়ে জনগনের সাথে প্রতারণায় মেতেছে। কিছু কিছু ব্যবসায়ী আবার নিষিদ্ধ পলিথিনে খাবার গুজে দিয়ে ভোক্তাকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে। তাদের অর্থ লোলুপ নেশায় বধ হচ্ছে শিশু বৃদ্ধ মধ্য বসয়সীসহ সকল শ্রেণী পেশার ভোক্তা।

অন্যদিকে বর্তমানে বাজারের উর্ধগতি নাগরিকের নাভিশ^াস দিনের পর দিন শুন্যে নিয়ে যাচ্ছে। অনবরতভাবে বেড়েই চলেছে প্রতিটি পণ্যের মুল্য। দিনের পর দিন বাড়তে থাকলেও কোন কর্তৃপক্ষের নেই কোন নজরদারি। মনে হচ্ছে যেন চোখ থাকতেও অন্ধ আর কান থাকতেও বধির কিছু দেখেন না কিছু শুনেন না। মাঝে মধ্যে আবার একে অপরকে দোষারোপ করে বিষয়টি এড়িয়ে চলতেও বেশ পাঁকা। দায়িত্বহীন ভাবে বলতে শোনা যায় আমাদের কিছু করার নেই। বাজার মুল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেলেও পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে নাগরিক সেবা সহায়তায় নেই কোন উদ্যোগ। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মধ্য কিংবা ফ্রান্ট লাইনের চাকুরীজীবি কিংবা দিনমজুরের পারিশ্রমিকের সাথে দ্রব্য মুল্যের নেই কোনো সামঞ্জাস্যতা। ফলে পুষ্টিকর আর নিরাপদ খাদ্য ক্রয়ের নেই কোন সুযোগ। চাল, ডাল, আটা, তেল, সকল ধরনের কাঁচা বাজার, শিশু খাদ্য লবনসহ অন্যান্য সকল মৌলিক প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার পর পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফলমুল ক্রয় সাধ্যের বাহিরে। এরফলে পরিবারে শিশু কিংবা বয়স্ক ব্যক্তির জন্য ফলমুল সমৃদ্ধ পুষ্টি অনিশ্চিত। আবার ফলমুল আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাপক খরচের দোহাই দিয়ে ব্যবসায়ীরা ফল আমদানি করে দীর্ঘ সময় দোকানে সংরক্ষণ করতে বিভিন্ন ধরনের ষ্টোরয়েড উপাদান মিশ্রণ কওে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে পুষ্টির বদলে মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়েই চলেছে। এসব দ্রব্য মাানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ঝুঁকির কারণ। দামের কথা বলাই বাহুল্য প্রতিটি ফলের বাজার একেক দোকানে একেক রকম উর্ধমুল্য।

খাদ্য দ্রব্যের উর্ধমুল্য নি¤œ আয়ের মানুষের জীবন জীবিকায়নে দুর্দিনের আগমন ঘটেছে। করোনা পরিস্থিতিতে নি¤œ আয়ের মানুষের আয় কমে যাওয়ায় বর্তমানে তারা কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে। বেঁচে থাকা যেখানে কষ্টকর সেখানে পুষ্টিকর খাবার কল্পনা করাও কঠিন। ফলে জনসংখ্যার একটি বড় অংশই সব সময় অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। করোনার নেতিবাচক প্রভাবে এই মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার অন্যদিকে বিভিন্ন খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কম সময়ে কম খরচে বেশি লাভের আশায় গুণগত মান পরীক্ষা ছাড়াই যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়াই বাজারে সরবরাহ করে জনস্বাস্থ্য অনিরাপদ করে তুলছে। ভোক্তা ও ব্যবসায়ীর সচেতনতা বৃদ্ধি, ভোক্তা সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ, বাজার নিয়ন্ত্রণ, ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে মোবাইল কোর্ট চালু এবং অধিক হারে মনিটরিং অত্যন্ত জরুরী। প্রয়োজনে ভেজাল মিশ্রিত প্রতিষ্ঠান বা ব্যাক্তিকে যথাযথ দণ্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। সামনে রমজানকে ঘিরে আগে থেকেই সঠিক কোন পরিকল্পনা না থাকলে কৃত্রিম সংকটের সুযোগ সন্ধানীরা ফয়দা লুটতে পারে ফলে সেটিও একটি উদ্বেগের বিষয়।

তবে আইন প্রয়োগ করে এই অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না পর্যন্ত ব্যবসায়ী এবং ভোক্তা নিজে না সচেতন হবেন। সকলের সচেতনতা সাথে আইনের ব্যবহার করে এই পরিস্থিতির উন্নতি করা সকলের দায়িত্ব হিসেবে চর্চা করতে হবে। আসুন সকলের প্রচেষ্টায় নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন এবং সরবরাহের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকিহ্রাস করি এবং দেশের উন্নয়নে সুস্থ্য সবল মানবসম্পদ উপহার দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত সংবাদ