স্মৃতিতে আল্লামা ফুলতলী রহ এর জানাযা
২০০৮ সাল। তখন হিফজে পড়ি। ইন্তেকালের কিছুদিন আগে মাদরাসার সব ছাত্ররা আল্লাহর ওলী ফুলতলী রহ. কে দেখতে ও দু'আ নিতে উনার সুবহানীঘাটের বাসায় মাদরাসার প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে দেখে এসেছি। সে এক মধুমাখা স্মৃতি!
তখন ছাহেব রহ.'র শারিরীক অবস্থা বেশী ভালো না। চারিদিকে উনার ভক্ত আশেকানরা যে যার অবস্থান থেকে বিভিন্ন খতম শরীফ ও দুআ চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের মাদরাসার ছাত্ররা মিলেও খতমে কোরআন পড়লাম। প্রধান শিক্ষক মহোদয় খুব পেরেশানি করছেন। মুবাইলে সুহৃদদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছেন, দুআ চাচ্ছেন।ব্যক্তিগতভাবে আল্লামা ফুলতলী রহ এর এতো আশেক লোক আমি খুব কম দেখেছি। ছাত্রদের নসিহতের সময় প্রায় সবদিন তিনি ফুলতলী রহ.র জীবন/চালচলন সম্পর্কে আলোচনা করতেন। খুটিনাটি ব্যাপারেও তিনি মুরশিদের বিচক্ষণতা,দয়া আর উসওয়ায়ে নববীর অনুসরণের কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতেন। বিভিন্ন কারামাত বয়ান করতেন।
কোন ব্যাপারে বেশী চিন্তা না করে কাজের দ্বারা সমাধান করার ব্যাপারে তিনি সিদ্ধহস্ত। প্রিয় মুরশিদের অসুস্থতার খবরে তাকে যেমন চিন্তিত দেখাচ্ছিল এরকমভাবে চিন্তিত অবস্থা প্রায় পৌনে তিন বছরের ছাত্রাবাস জীবনে কখনো দেখিনি।
হযরত ফুলতলী ছাহেব রহ যে রাতে ইন্তেকাল করেন ঐ রাতে হুজুর অনেক পেরেশানি করে বিছানায় গড়াগড়ি করছেন। দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছে না এমন সময় ফোন পেলেন আল্লামা ফুলতলী রহ ইন্তেকাল করেছেন। আমরা সে খবর জানতাম না। ফজরের আগেই আমাকে ডেকে খবর দেয়া হল কে জানি আমার আত্মীয় এসেছেন। নিচতলায় গেটের কাছে গিয়ে দেখলাম ফুফাতো ভাই (ইমরান) বাইসাইকেল নিয়ে এসেছেন। তখন তিনি মিরাবাজার মৌসুমি আবাসিক এলাকায় মেসে থাকতেন। আমাকে বললেন, আমি হুজুরকে বলেছি। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও ছা'ব নাই। যেতে হবে।
খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে উনার সাইকেলে করে বাস স্টেশনে চলে গেলাম। বাস কাউন্টারে তাদেরকেও দেখতে পেলাম।স্টেশনে গিয়ে দেখলাম যত যাত্রী এসেছেন তাতে প্রায় এক বাস হয়ে যাবে। সবাই বললেন গাড়ি ছেড়ে দিতে। তারা বলল, তাদের নিয়ম ফজর পরে প্রথম ট্রিপ। স্টেশন মসজিদে আজানের পরেই ফজর নামাজ আদায় করে বাসে উঠলাম।
খুব স্পিডে বাস এগুতে থাকল। কোন যায়াগায় এক মিনিটও থামেনি।
ফুলতলীতে পৌছে দেখলাম ছাহেবের লাশ এনে উনার নতুন বাড়িতে রাখা হয়েছে।এলাকার ভক্ত মুরিদরা সারি ধরে লাশ দেখছেন। তখনো বাইরের কোন গাড়ি আসেনি৷ ছাহেব রহ এর লাশবাহী গাড়ির পরে প্রথম বাসে আমরাই পৌছলাম।
লাশ দেখে বাড়িতে যাওয়ার পথে কবর খোঁড়া হচ্ছে দেখলাম। দারুল কিরাতে পড়ার সময় শুনতাম মুর্শিদি ফুলতলী রহ. নিজের কবরের যায়গা চিহ্নিত করে দিয়েছেন। বাড়িতে গিয়ে দেখলাম ফজরের পরে সবাই নাস্তা করছেন। একটু পর থেকেই মানুষ আসা শুরু হল। বাড়ির উঠোন, পিছন সব দিকেই লোক আসছে৷ যে যেদিকে পারছে যাচ্ছে।
কত মানুষের জমির ধান নষ্ট হয়েছে, বাড়ির বেড়া ভেঙ্গে মানুষ চলাচলের পথ করেছে তা বলা মুশকিল। ভালো লাগার মতো কথা হল, অনেক মানুষকে বলতে শুনলাম ছাব কে ছিলেন থাকতে সময় চিনতে পারিনি। সে সময় এত বড় বুযুর্গকে চিনার মতো বয়স হয়নি। দিন দিন যেন নতুন পরিচিত হচ্ছি উনার মাহাত্ম্যর সাথে৷ কি এমন জিনিস অর্জন করেছিলেন যার সুনাম এখনো দেশে দেশে ছড়াচ্ছে।
যে যার অবস্থান থেকে এগিয়ে এসেছে। গ্রামের কচি বাচ্চারা জগ, বালতি এবং কলসে করে তৃষ্ণার্ত মানুষকে পানি পান করিয়েছে। তাদের মুখে আসেন পানি খেয়ে (পান করে) যান শব্দগুলোর যে যে মাধুর্য ছিল এখনো তা কানে বাজে।
রতনগঞ্জ থেকে আটগ্রাম জকিগঞ্জ রাস্তা দুপুরের দিকেই গাড়িতে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আট দশ কিলোমিটার পথ হেঁটে এসে যখন পানি পান করতে পেরে যে দুআ দিয়েছিল সেটা বহু বড় পাথেয়।
জোহরের পরে আস্তে আস্তে তৈরি হয়ে জানাযার মাঠের দিকে গেলাম। লোকের ভীড় ঠেলে সামনে আগালাম। পিছনের দিকে থাকলাম। আছরের নামায আদায় করে আরেকটু পেছনে গিয়ে পুকুর পাড়ে দাঁড়ালাম কামরান ভাইয়ের বুদ্ধিতে। যাতে করে মানুষ দেখা যায় এবং লাশ কবরে নিয়ে যাওয়ার আগেই একটা সুবিধামতো যায়গায় যেতে পারি।
বিদগ্ধ আলেম, জ্ঞানী পন্ডিত ব্যক্তিরা মাইকে স্মৃতিচারণমূলক কথা বলছেন। আমার কাছে সব থেকে আকর্ষণীয়, আবেগী, দৃঢ় প্রতিজ্ঞাপূর্ণ মনে হয়েছে কবি রুহুল আমিন খান সাহেবের বক্তব্য। মুর্শিদের রেখে যাওয়া খিদমাতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে, মুর্শিদের দেখানো ইশকে রাসুলের পথে অটল থাকা, মুর্শিদের পরে যেন বিভ্রান্তিতে পড়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বক্তৃতা দেন এবং সংকল্প করান।
মুফতি সাহেবের দরাজ কণ্ঠে শুনতে পেলাম লোকসমাগম বেশী হওয়ায় আর যেহেতু জানাযার নামায তাই কাতারের মধ্যখানের ফাঁক কম রাখলে চলবে৷ একটু পর বড় সাহেবের হৃদয়গ্রাহী গম্ভীর কন্ঠে ধ্বনিত হল, আল্লাহু আকবার।।
জানাযা শেষ হতেই অন্য কোথাও সুবিধা করতে না পেরে তাড়াতাড়ি মসজিদের দু'তলায় উঠলাম। ভক্তরা যেন কবরে মাটি দিতে পারেন সেজন্য কিছু ভাইয়েরা মাটি নিয়ে ভক্তদের হাত ছুইয়ে এনে কবরে দিলেন। তাতে অনেকের মনে কবরে মাটি দেয়ার যে আকাঙ্ক্ষা ছিল তা কিছু হলেও মিটলো। দৌড়ে মসজিদের দিকে রওয়ানা হওয়ার আগে মনে হল কবরের ওখানে তো যেতে পারব না তাই শুকনা কয়েকটা মাটির দলা পকেটে নিলাম।
দু'তলা থেকে কবরে মাটি দেয়ার দৃশ্য দেখার সাথে সাথে নিজের পকেট থেকে মাটির দলা হাতে নিয়ে গুড়ো করে হাওয়ায় ছেড়ে দিলাম৷ ছা'ব এর কবরে মাটি দেয়ায় শরীক হলাম। নিচে তো যাওয়ার উপায় নাই। আমিও ছোট৷ তাছাড়া আমাকে কে বা চিনে? সেজন্য এ পদ্ধতি অবলম্বন।
দু'তলা থেকে সবকিছু দেখলাম। দাফন পরবর্তী দু'আয় অংশগ্রহণ করলাম।
লেখকঃ রুম্মান আহমদ চৌধুরী