Teaching: শিক্ষকতা পেশায় শ্রেষ্ঠ কিন্তু বেতনে?
"শিক্ষকতা "শব্দটি শোনামাত্রই নায়ক রাজ রাজ্জাক অভিনীত "প্রফেসর" সিনেমাটির কাহিনি আমাদের কিছুটা স্বস্তির দিলেও ওপার বাংলার "বিধিলিপি" সিনেমায় কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়ের মাধ্যমে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের করুণ অবস্থা নিশ্চয়ই দেশ জাতি ও সমাজের জন্য ধিক্কার স্বরূপ।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আলোচনাটা দাঁড় করাই। আমাদের দেশে শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করে দেশ -জাতি ও সমাজ সেবা করার তীব্র ইচ্ছা কেবল পরীক্ষার খাতায় "আমার জীবনের লক্ষ" রচনায় শোভা পায়। ছাত্রের সুনিপুণ লেখনী ও উচ্চ চিন্তাধারা শিক্ষক কর্তৃক ভালো নম্বর প্রাপ্ত হলেও এই শিক্ষককেই নিজ সন্তানের ব্যাপারে জীবন লক্ষ স্থিরকরণে নিজ সন্তানকে নিজ পেশায় আহবান করবেন কিনা তা সন্দেহ। কেননা যেখানে নিজেকে আত্মসম্মানের ভয়ে বার বার তিলে তিলে জলাঞ্জলি দিচ্ছে, সেখানে নিজ সন্তানের নিজ পেশায় আগমন নিশ্চয়ই কোনো পিতা তার সন্তানের জন্য চাইবেনা। কেননা প্রত্যেক পিতা-মাতা চায়, তার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।
বোধ করি, একজন ছাত্রের কল্পনার রাজ্যে শিক্ষকের সুআচরণ, স্নেহ, ভালোবাসা সবমিলিয়ে নিজেকে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন সৃষ্টি করে। আর সেই বাসনা থেকেই হয়তো "আমার জীবনের লক্ষ" রচনায় শিক্ষক হওয়ার বাসনার আগমন ঘটে। এই ছাত্রটি যখন সমাজ বাস্তবতা বুঝতে শিখে তখনই তার জীবনের লক্ষ পরিবর্তিত হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বিসিএস ক্যাডারে রূপান্তরিত হয় । কেননা এই পেশায় অর্থ ও সম্মান দুটিই যথেষ্ট।
চাকরির যুদ্ধে মেধাবীরা ডাক্তার ,ইঞ্জিনিয়ার হয়ে জীবন সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করে। আর ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা থাকার সত্ত্বেও ব্যর্থতার ফলে শিক্ষকতার পেশায় আসে মন ভাঙ্গা অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা। এ যেন ভাগ্যদোষে শিক্ষকতা পেশায় আগমন। তবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীরা জীবিকা নির্বাহের তাগিদে শিক্ষকতা পেশায় আসে। এখন প্রশ্ন, অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকতা পেশায় আসা অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের দ্বারা যুগোপযোগী, গবেষণা নির্ভর, মেধাসম্পন্ন ছাত্রসমাজ প্রত্যাশা করতে পারি? যে ছাত্রসমাজ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলবে। তার উত্তরে- নিশ্চয়ই পাঠক ভালো করে অবগত।
আমরা উন্নত বিশ্বের দিকে তাকায় ।পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো আমাদের তুলনায় শিক্ষকতা পেশাকে বহুগুণে সম্মানের চোখে দেখে। শুধু সম্মানের চোখে দেখে , এটা বললে ভুল হবে কেননা সম্মানের সাথে সাথে তারা শিক্ষকদের প্রাপ্য সন্তোষজনক অর্থ প্রদান করে থাকে। তারা সম্মানজনক চৌদ্দটি পেশার মাঝে সপ্তম স্থানে রেখেছে শিক্ষকতা পেশাকে।
এক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষকদের সামাজিক সূচকে ১০০ পয়েন্টের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ চীনের সূচক ১০০, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে গ্রীস (সূচক ৭৩ দশমিক ৭), তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে তুরস্ক (সূচক ৬৮), খারাপ সূচকে সবচেয়ে এগিয়ে ইসরায়েল (সূচক ২), দ্বিতীয় (ব্রাজিল ২ দশমিক ৪), তৃতীয় চেক প্রজাতন্ত্র (১২ দশমিক ১)।
সেই তুলনায় আমাদের দেশে শিক্ষকদের অর্থ ও মর্যাদার অবস্থা "দৈনিক কালের কণ্ঠ" তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন দেখলেই বুঝতে পারব। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- সরকারি প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তাঁরা ১৩তম গ্রেডে ১১ হাজার টাকার স্কেলে বেতন পান সাকল্যে ১৯ হাজার টাকা। প্রতিবেশী ভারতে প্রাথমিকের এই পদমর্যাদার শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আর এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা শুরুতে ১১তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মূল বেতনের সঙ্গে এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান।
এখন একটু সম্ভাবনাময় বাস্তবতার প্রসঙ্গে আসি, যদি আমাদের দেশে শিক্ষকতা পেশায় বেতন আশানুরূপ হতো, তাহলে এই পেশার আশানুরূপ মর্যাদা ও অর্থের প্রেক্ষিতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচিত হতো মেধাবী প্রজন্মের কাছে। অতএব জাতি পেত এক মেধাবী শিক্ষক। যখন মেধাবী শিক্ষক থাকত তখন নিশ্চয়ই জাতির যুগোপযোগী, গবেষণা নির্ভর, মেধাসম্পন্ন ছাত্রসমাজ প্রত্যাশা করা পানির মতো সহজ ব্যাপার হতো। আর আর তৈরি হতো মেধাবী ছাত্র সমাজ। এই মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে নিশ্চয়ই উন্নত দেশের সারিতে পৌঁছাতে বেশি সময় নিত না।
এখন সরকারের উচিত শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করা ও তাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়া। যখন শিক্ষকতা পেশায় আশানুরূপ বেতন পাওয়া যাবে, সেই সাথে সাথে শিক্ষকদের কোচিং বা প্রাইভেট বাণিজ্য বন্ধ হবে। তখন নিশ্চয়ই ক্লাসে শিক্ষকের সক্রিয়তা বাড়বে। তবে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট বা কোচিং একান্তভাবে দরকার হলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বেকার শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াবে।
কিন্তু সরকারি নিশ্চিত করতে হবে যেন কোনো শিক্ষার্থীর প্রাইভেট পড়া না লাগে, যেন ক্লাসের পড়া ক্লাসই শেষ। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বেকার শিক্ষার্থীরা তারা তাদের পড়াশোনার খরচ ও হাত খরচ অনায়াসে বহন করতে পারছে, অন্যদিকে বেতন বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে শিক্ষক সমাজ সচ্ছন্দে বসবাস করতে পারছে।
একটা বাস্তব বিষয় খেয়াল করি, পাঠকের কাছে প্রশ্ন, স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের আলাদা জায়গায় প্রাইভেট পড়তে হয় কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোনো প্রাইভেট পড়তে হয় না কেন? উত্তরটা হলো, একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী হিসাবে বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছি, স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ক্লাসের ব্যাপারে বেশি সক্রিয়। ক্লাসের পড়া ক্লাসই শেষ হয়ে যায় । তখন প্রাইভেট পড়াও অবশ্যই অনর্থক।
আমরা চাই একজন আদর্শ শিক্ষকের স্পর্শ প্রতিটি শিক্ষার্থী, সেই আদর্শ শিক্ষকের স্পর্শে আলোকিত হোক তার জীবন।
শেখ সায়মন পারভেজ হিমেল।
শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ,
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়